তরিকুল ইসলাম তরুণ, কুমারখালী (কুষ্টিয়া)
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। হত্যার দুই বছরেও বিচারের অপেক্ষা কাটেনি আবরারের পরিবারের। দ্রুত সময়ে সব আসামিদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন তারা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ সামাজিকমাধ্যমে আবেগঘন একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন, যেটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো
'আজ ভাইয়ার ২য় শাহাদাৎবার্ষিকী'
২০১৯'র ৭ অক্টোবর রাত ২:৫০-৩:০০টার মধ্যেই ছাত্রলীগের কয়েকজন নির্মমভাবে পিটিয়ে মাত্র ২১ বছর বয়সেই আমাদের কাছে থেকে ভাইয়াকে চিরদিনের মতো দূরে সরিয়ে দেয়...
বিচার শুরু হয়েছে প্রায় ২ বছর হতে যাচ্ছে। এখনো রায় কবে হবে জানি না। আর উচ্চ আদালতের রায় কবে পাবো? সে তো ভাবতেও সাহস পাই না।
সেদিন সকালে ৬টায় যখন ভাইয়ার এই খবর দেখি, জানি না কিভাবে সহ্য করেছিলাম। শুধু বলেছিলাম, কিভাবে সম্ভব! হয়তো ভুল পড়েছি। ৩ বার পড়েছিলাম। আম্মু একাই বুঝে গেছিল। আব্বু হঠাৎ কেঁদে উঠে বলে, ‘হায় আল্লাহ কি হলো আমার ছেলের!’ যখন শরীরের সর্বত্র আঘাতে কালো হওয়া শরীরটা দেখি, শুধুই ভাবছিলাম আম্মু না থাকলে যেই হাতে মাথা দিয়ে ঘুমাতাম, যেই হাত জড়িয়ে ধরত, যে পায়ের ওপর ভর দিয়ে হাঁটত, ঐ পশুরা কি অবস্থা করেছে সেই হাত-পায়ের। সুযোগ হয়নি নিজ চোখে সে দেহ দেখার।
পোস্টমর্টেম যখন চলছিল, ভাবছিলাম ঐভাবে ওকে কেটে চিরে ফেলবে! কিছু করার ছিল না। ১৭ বছর বয়সে কতজনকে তার ৪ বছরের বড় ভাইকে নিজ হাতে কবরে নামাতে হয়েছে? শুধু একটা জিনিসই অনুভব করেছিলাম, পুরো শরীরই গলে গেছে। এরপরও বহু ঘটনা হয়েছে। পুরো দেশ দেখেছে।
তবে মামলা এতদিনে কেন শেষ হলো না, এ জন্য কাউকে দোষ দেওয়ার থেকে বেশি মনে হয়েছে যে আমাদের কপালে এত দ্রুত এদের শাস্তি দেখাটা নেই। নতুবা এত বাধা কেন আসবে! গত প্রায় ২ বছর আব্বুকে দেখছি মামলার জন্য মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজেদের যে কতটা অসহায় লাগে, সেটা কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।
আর আম্মুর কান্না সেটা এখনো থামেনি। আব্বু মাঝেমধ্যেই বাসায় থাকে না। তখন গভীর রাতে শুনি আম্মু ডুকরে উঠে কাঁদছে। যখনই কারোর সাথে দেখা হয়, আম্মু বলে ওঠে, ‘আমার ছেলের জন্য একটু দোয়া করবেন। ও তো আমার কিছুই নিয়ে গেল না। একটু দোয়াই তো শুধু এখন দিতে পারি।’ আম্মুর কান্না এখন আর থামানোর চেষ্টা করতে পারি না। কারণ, আমার কাছে এমন কোনো কথা নেই যা তার কষ্ট কমাতে পারবে। গত দুই বছরে আব্বু-আম্মু শারীরিকভাবেও যে কতখানি ভেঙে পড়েছে তা এখন পুরোই স্পষ্ট।
এখন আর একা একা থাকতে পারি না। চুপচাপ থাকলেই খালি চোখের সামনে ভেসে ওঠে পরীক্ষার হল থেকে বের হওয়ার সময় কিভাবে ভাইয়া বুকের ভিতরে জড়িয়ে ধরেছিলো। দুইজন একসাথে হাত ধরে রাস্তা পার হতাম। একই সাথে খেতে যেতাম। আর ভাইয়ার হলে থাকা সেদিনগুলো কিংবা মামার বাসায় শুধু আমি আর ভাইয়া পাশাপাশি বসে খাচ্ছি, কথা বলছি এগুলো মাথার ভিতরে ঘুরতে থাকে। আর এই পুরো সময়ের সবচেয়ে বড় উপলব্ধি কাউকে নিজের মনের অবস্থা কোনোভাবে একটুও বুঝানো সম্ভব না, আর না কেউ বুঝার চেষ্টা করে। পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে নিজের ভেতরেই সব খারাপ লাগা গুলো চেপে রাখতে হয়।
বাকি জীবন এভাবেই হাজারো অভাব নিয়ে কাটাতে হবে আব্বু-আম্মুকে। জানিনা তারা কত কষ্ট চেপে কাটাচ্ছে এই দিন। বাবা-মা'র সামনে ছেলের কবর,ছেলের খুনিরা। আচ্ছা ঐখুনিদের বাবা-মাগুলো কী দেখেনি কিভাবে একটা সুস্থ ছেলে হাটতে হাটতে গেলো আর লাশ হয়ে ফিরলো তাদের জন্ম দেয়া পশুগুলোর জন্য? সবাই ৫-৬ তারিখেই হলে ফিরছিল। ভাইয়াও তো তাই গেছিল। এতজনের মধ্যে শুধু ঐ লাশ হয়ে কেন ফিরল! আমাদের কী এমন দোষ ছিল যার জন্য এতবড় শাস্তি আমাদের পরিবারের? মাঝে মাঝে ভয় হয় বিচার না হলে কী নিজেকে কোনো দিন ক্ষমা করতে পারব! অন্তত আমার কিছু হলে তো ভাইয়া কোনো দিনই ওদের বাঁচতে দিত না। আমরা ওর জন্য কতদূর কী পারব জানি না।
আমার ভাইয়ার জন্য দোয়া করবেন। অনেকভাবে অনেকেই ভাইয়াকে স্মরণ করে থাকেন। তাদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ। আমাদের সকলের কাজের মধ্য দিয়েই আবরার ফাহাদ চিরকাল বেঁচে থাকবে এটুকুই চাওয়া।’
ওডি/এফই
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড