শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার
চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের আওতাধীন কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপকূলে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থায়নে টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) শীর্ষক প্রকল্পে বনায়নের নামে কোটি কোটি টাকা হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৯-২০২০ ও ২০২০-২০২১ এই দুই অর্থবছরে অন্তত ৮ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপকূলে সরকারের হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। সাগরবেষ্টিত এই দ্বীপে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের অধীনে ১২ নম্বর মহেশখালী মৌজায় রয়েছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ও পাহাড়ি বন। এরমধ্যে মহেশখালী রেঞ্জের ৫টি বনবিটের অধীনে বনভূমি রয়েছে ১৮ হাজার ২৮৬ দশমিক ৪০ একর।
উপকূলীয় অঞ্চলে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত এসব পাহাড়ে দেখা মিলত বিভিন্ন প্রজাতির পশু পাখি। শোনা যেত পাখির কোলাহল। কিন্তু বন দখল, পাহাড় কাটা ও বনায়নের নামে বিশ্ব ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে লুটপাটের ফলে নষ্ট হচ্ছে সিংহভাগ বনভূমি। একই সাথে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে হাজার হাজার পানের বরজ ও বসতি। তবে কাগজে-কলমে হিসেব ঠিক থাকলেও বাস্তব চিত্র পুরো উল্টো। এ যেন সাগর চুরি!
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিজিটাল আইল্যান্ডে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে প্রাণ ও জীববৈচিত্র্য ফিরে আনার জন্যে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ‘সাসটেইনেবল ফরেস্ট অ্যান্ড লাইভলিহুড (সুফল) প্রজেক্ট’ বা টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বন অধিদফতরের বাস্তবায়নাধীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সুফল প্রকল্পের বনায়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংক ২০১৯-২০ অর্থ বছরে প্রায় ৬ কোটি ৪২ লাখ ৪৯ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন। কিন্তু ২০২০ সালে করোনাকালীন বনায়ন না করেই সিংহভাগ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
মহেশখালীর শাপলাপুর বিট, দিনশপুর বিট ও মুদির ছড়া বনবিটের অধীনে সুফল প্রকল্পের বনায়ন করা হয়েছে বলে কাগজে-কলমে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে কোনো বনায়নের খোঁজ পাওয়া যায়নি। সুফল প্রকল্পের বনায়ন সৃজন করা হয়েছে বলে বন বিভাগের তরফ থেকে দাবি করা হলেও সংরক্ষিত বনের ভেতরে পাহাড় কেটে ও বৃক্ষ নিধন করে গড়ে উঠেছে প্রায় ১৫ হাজার অবৈধ পানের বরজ। আর মহেশখালী রেঞ্জে ১৮ হাজার ২শ’ হেক্টর বনভূমির মধ্যে কাগজে-কলমে ৪৬০ হেক্টর বনায়ন রয়েছে। অবশিষ্ট বনভূমি বেহাত হয়ে গেছে।
এ দিকে, মিশ্র প্রজাতির দ্রুত বর্ধনশীল, কম বর্ধনশীল বাগান, সমৃদ্ধি (এনরিচমেন্ট), স্ট্যান্ড উন্নতি (স্ট্যান্ট ইম্প্রুভমেন্ট), বেত, বাঁশ ও এএনআর বাগান করার কথা ছিল এই প্রকল্পের আওতায়। কিন্তু যৎসামান্য ও লোক দেখানো বনায়ন যেখানে হয়েছে, সেখানে দেশীয় প্রজাতির চারা রোপণের নির্দেশনাও যথাযথভাবে পালন করা হয়নি। সুফল প্রকল্পে সব নিয়মই এখানে অমান্য করা হয়েছে। এ ছাড়া বনজ সম্পদ উজাড় রোধ ও বন নির্ভর জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবিকা সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো নির্বিচারে পাহাড় কেটে প্রতিটি বাগানের ভেতর ও আশপাশে পানের বরজে ছেয়ে গেছে। এমনকি অবৈধ এসব পানের বরজের মালিকের খরচে কিছুকিছু চারা রোপণ করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বনায়ন রক্ষণাবেক্ষণ না করে বরাদ্দের টাকা ভাগবাটোয়ারা করেছে বন বিভাগ- এমন অভিযোগেরও শেষ নেই।
অন্যদিকে, ২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা বরাদ্দে স্ট্যান্ট ইম্প্রুভমেন্ট, এনরিচমেন্ট, বাঁশ, বেত বাগান সৃজনের কথা থাকলেও নামমাত্র লোক দেখানো বনায়ন সৃজিত হয়েছে। পাহাড়ের ঢালুতে প্রথম ধাপগুলোতে বিক্ষিপ্ত কিছু চারা লাগানো হলেও সেই সকল স্থানে চারাগুলোর যথাযথ পরিচর্যার অভাবে এখন প্রায় শূন্য। সরকারি বনজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানোই ছিল সুফল প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। তবে মহেশখালীতে বন উজাড় রোধ ও বননির্ভর জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবিকা সুবিধা দেওয়ার সেই মহৎ উদ্যোগও ভেস্তে গেছে।
জানা গেছে, ঢাকা আগারগাঁও বন ভবন, প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে প্রেরিত টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) প্রকল্প গত ২১ জুন, ২০২০ সালে পত্র নম্বর বঅ/সুফল/বাজেট/২০১৮/৩/২০১৯-২০২০/৬৬১ মূলে এই প্রকল্পের ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের চূড়ান্ত বরাদ্দ (Net Grant) প্রেরণে পত্র দেওয়া হয়। পরে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বন অধিদফতর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) শীর্ষক প্রকল্পের ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের চূড়ান্ত বরাদ্দ (Net Grant) ছক মোতাবেক উপখাতসহ ২০১৯-২০২০ সালে ৬ কোটি ৪২ লাখ ৪৯ হাজার টাকা উপকূল বন বিভাগ চূড়ান্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরমধ্যে করোনাকালীন সময়ে ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বনায়ন হয়েছে মহেশখালী রেঞ্জের ৫টি বনবিটে। কিন্তু মুদিরছড়া ও দিনেশপুর বিটে সুফলের কোনো বনায়ন করা হয়নি। এই দুই বিটে কোনো বনায়ন না করেই প্রায় আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। তৎকালীন টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. রকিবুল হাসান মুকুল এই বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড় দেন বলে জানা গেছে। তবে তিনি ওই বছর চাকরি ছেড়ে অবসরে চলে গেছেন।
সুফল প্রকল্পের জন্য ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে যেসব খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে এসব খাতের মধ্যে রয়েছে- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে উপকূলীয় বনবিভাগ সুফল প্রকল্প থেকে ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা, ম্যানগ্রোভ বাগান (কেওড়া ও বাইন), ম্যানগ্রোভ এনরিচমেন্ট বনায়ন, গোলপাতা বনায়ন, মাউন্ড বনায়ন, স্ট্রীপ বনায়ন, এনটিএফপি আন্ডার প্ল্যানটেশন বেত বাগান, বাঁশ বাগান সৃজন, এএনআর বনায়ন, স্ট্যান্ড ইন প্রুভমেন্ট উইথ ইনডিজিনাস, স্পেসিস অর্থাৎ ১ হাজার ৫০০ সিডলিংস হে আফটার স্যানিটেশন কাটিং, এনরিচমেন্ট বনায়ন, দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির মিশ্র বনায়ন দেশীয় বিরল প্রজাতির ৮০ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ সেগুন (তাও স্ট্যাম্প দেওয়া হয়), এনডিএফপি আন্ডার প্ল্যানটেশন বেত বাগান, বাঁশ বাগান সৃজন ইত্যাদি। এতে অন্তত ৬ কোটি টাকার মধ্যে পরামর্শক ও বিশেষজ্ঞের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ ছাড়া সভা/ ওয়ার্কশপ, সেমিনার/ কনসালটেশন ইত্যাদির জন্য ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, তিনটি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগের সমন্বিত বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য জরীপ ব্যয় ৩ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এগুলো ছাড়াও প্রকাশনা, বিজ্ঞাপন, সভা-সেমিনার প্রচারণার নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন : কালিগঞ্জে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ, তদন্তে ইউএনও
এ ব্যাপারে মহেশখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা অভিজিতের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি।
একইভাবে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আবদুর রহমানও এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। তবে তিনি বলেন, ‘আমি সদ্য যোগদান করেছি, আগের বরাদ্দগুলো আমার জানার কথা নয়।’
এ দিকে, স্থানীয়দের দাবি- ৯০ দশক আগেও এই মহেশখালীর পাহাড়ে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ছিল। ছিল নানা রং-বেরঙের পশু-পাখির অভয়ারণ্য। শোনা যেত পশু পাখির কোলাহল। তবে বন বিভাগের রহস্যজনক নীরবতায় পাহাড় কাটা আর বৃক্ষ নিধনের কারণে উপকূলীয় সংরক্ষিত পাহাড়ের এসব প্রাণ ও জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
ওডি/নিলয়
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড