• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

৫০ বছর ধরে একটি সেতুর দাবি লালুটিয়া চৌকিদারফাঁড়ি এলাকাবাসীর

যুগের পর যুগ জনপ্রতিনিধিদের 'আশ্বাস' তাদের ভুলিয়ে রেখেছে

  মোঃ কামরুল ইসলাম মোস্তফা, চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম)

২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:৫৬
সেতু
দোহাজারী পৌরসভাধীন লালুটিয়া চৌকিদারফাঁড়ি ঘাট। ছবি: দৈনিক অধিকার

চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পৌরসভাধীন 'লালুটিয়া চৌকিদারফাঁড়ি' ও সাতকানিয়া উপজেলার পুরানগড় ইউনিয়নের 'নয়াহাট' দুইটি পাশাপাশি গ্রাম। কিন্তু গ্রাম দুইটিকে শত শত বছর ধরে বিভাজন করে রেখেছে খরস্রোতা সাঙ্গু নদী। শুধু দোহাজারী পৌরসভা ও পুরানগড় ইউনিয়ন নয় পার্শ্ববর্তী ধোপাছড়ি, বাজালিয়াসহ আরো কয়েকটি ইউনিয়নের লোকজনদের এ নদী নৌকাযোগে পেরিয়ে এপার-ওপার আসা যাওয়া করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। বর্ষাকালে এ দুর্ভোগ আরো চরমে ওঠে যখন খরস্রোতা এ নদীতে পানি বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরকেই সীমাহীন কষ্ট ভোগ করতে হয়। তাছাড়া প্রতিবার নৌকাযোগে এ নদী পাড়ি দিতে ইজারাদারদের হাতে নগদ টাকা প্রদানের বিষয়টি অনেকটা শাখের করাতের মতো।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেলেও মহান স্বাধীনতা লাভের ৫০ বছরেও মুক্তি মেলেনি নৌকাযোগে সাঙ্গু নদী পারাপারের দুর্ভোগ থেকে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে প্রতিবারই দেশে জাতীয় সংসদের নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা ভোট চাইতে এসে লালুটিয়া চৌকিদারফাঁড়ি এলাকায় একটি সেতু নির্মাণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতার বিষয়টি ভিন্ন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতার দুয়ারে পৌঁছে যাওয়ার পর কেউ তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি স্বপ্নের এ সেতুটি নিয়ে।

স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে তারা জানান, বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান দিয়াকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প উদ্বোধন করতে আসলে চৌকিদারফাঁড়ি ঘাট পরিদর্শন করেন। ওই সময় স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে সাঙ্গু নদীর ওপর চৌকিদারফাঁড়ি-নয়াহাট সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। তার আশ্বাসের পর স্থানীয়রা আশান্বিত হলেও শুধুমাত্র দুই থেকে আড়াই'শ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু সাঙ্গু নদীর ওপর নির্মাণ করে দু'পাড়ের সেতুবন্ধন রচনায় এই দীর্ঘ সময়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। এপার ওপারের লোকদের স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি দুর্ভোগের মাঝেই কাটাতে হচ্ছে। আর এ একটি কারণে দোহাজারী পৌরসভা ও পুরানগড় ইউনিয়নসহ আশপাশের ইউনিয়নগুলোর লোকজনের মাঝে বিভাজনের একটি ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে এই খরস্রোতা সাঙ্গু নদীর জলরাশির মধ্য দিয়ে।

ফলে পূর্বপাড়ের প্রায় ৩০টি গ্রামের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী, কৃষক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে সকলের দুর্ভোগ লেগে থাকে প্রতি বছর। এ সেতুটি নির্মিত হলে দু'টি উপজেলার সাথে যেমন সংযোগ স্থাপন হবে তেমনি নৌকাযোগে সাঙ্গু নদী পাড়ি দেওয়ার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবে হাজার হাজার মানুষ। পাশাপাশি দুই পাড়ের পাঁচ সহস্রাধিক কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি শতভাগ নিশ্চিত হবে এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবানে যাওয়ার একটি বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে।

এ সেতুর সুফল সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্থানীয়রা বলেন, বছরের পর বছর আমাদের কি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তা কেউ অনুভব করেনি। সেতুটি নির্মিত হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবজি ভান্ডার হিসেবে খ্যাত এ অঞ্চলের কৃষকদেরকে আর তাদের উৎপাদিত সবজি বা অন্যান্য ফসল বিক্রি করতে যেমন হিমশিম খেতে হবে না তেমনি তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। সেতু না থাকায় শিক্ষা, চিকিৎসা ও ব‍্যবসা বাণিজ্য সহ বিভিন্ন দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষ। নদীর দু পাড়ে রয়েছে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসা যাওয়া করতে হয়।

দোহাজারী কিল্লাপাড়া গ্রামের শাহ্ আলম রুবেল বলেন, আমরা জন্মের পর থেকে শুনে আসছি যে, চৌকিদারফাঁড়িতে সাঙ্গু নদীর ওপর সেতু হবে, কিন্তু আজ পর্যন্ত সেতুর কোনো কাজ দেখতে পেলাম না। নির্বাচন এলে সবাই শুধু আশ্বাস দিয়ে থাকে, কিন্তু সেতু আর হয় না। চন্দনাইশ উপজেলা কৃষকলীগ সাধারণ সম্পাদক নবাব আলী বলেন, চৌকিদারফাঁড়ি-নয়াহাট ঘাট দিয়ে চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলার হাজার হাজার মানুষ সাঙ্গু নদীর ওপর দিয়ে নৌকাযোগে আসা যাওয়া করে। সেতু না থাকায় মানুষ অনেক দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশেষ করে শিশু, শিক্ষার্থী ও নারীরা বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। চট্টগ্রাম-১৪ আসনের মাননীয় এম পি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী সেতুটির নির্মাণকাজ দ্রুততম সময়ে শুরু করার ব‍্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। আশা করছি দেরিতে হলেও সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হবে।

জানা গেছে, দোহাজারী জিসি-লালুটিয়া ভোমাংহাট জিসি সড়কে চেইনেজ ৫৫১০মিটারে সাঙ্গু নদীর ওপর ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে (২২০মিটার দৈর্ঘ্য ও ৭.৩০মিটার প্রস্থ) পিসি গার্ডার ব্রীজ নির্মাণের প্রস্তাব একনেকে পাস হয়ে আসার পর ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্থানীয় সাংসদ মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী। এরপর ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর সাংসদ নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে ঢাকা থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল চৌকিদারফাঁড়ি-নয়াহাট এলাকায় প্রস্তাবিত সেতুর স্থান নির্বাচন, পরিবেশগত সমস্যা এবং ব্যয় বরাদ্দের ব্যাপারে পরিদর্শনে আসেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ঢাকা কার্যালয়ের মৃত্ত্বিকা বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ অসীম উদ্দিন, পরিবেশ পরামর্শক আশরাফুল আলম, অর্থ পরামর্শক আশীষ ধর।

প্রতিনিধিদলের আসার খবরে দুই পাড়েই মানুষের ঢল নামে। শত শত উৎসুক লোকজন এসময় প্রতিনিধি দলের কাছে এখানে একটি সেতু নির্মাণের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন এবং সেতু নির্মাণের স্বার্থে এলাকার লোকজনের দখলে থাকা জায়গা বিনাশর্তে ছেড়ে দেয়াসহ সবধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। উপস্থিত প্রতিনিধি দলের সদস্যরাও কোন বাধাবিপত্তি ছাড়াই শঙ্খ নদীর উপর চৌকিদারফাঁড়ি-নয়াহাট এলাকায় একটি সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইপূর্বক স্থান নির্বাচন করে নেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ওই সময় জানিয়েছিলেন তারা খুব দ্রুত তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়ে বুয়েট থেকে একটি সেতুর ডিজাইন অনুমোদন করিয়ে নেবেন এবং প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করে টেন্ডার প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে যাবেন। এর পর দীর্ঘ তিন বছর পেরিয়ে গেলেও নির্মাণকাজ শুরু না হওয়ায় জনগণের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।

এ ব্যাপারে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর চট্টগ্রাম'র নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম আমিরুজ্জামান দৈনিক অধিকারকে বলেন, "এই সেতুটি করতে হলে বিআইডব্লিউটিএর ক্লিয়ারেন্স লাগবে। ১২ মিটার উচ্চতার ক্লিয়ারেন্স করতে গেলে সেতুটির দৈর্ঘ্য অনেক বেড়ে যাবে। নতুন বিধিমালা মেনে সেতুটি করতে হলে পুনরায় ডিজাইন করে নতুনভাবে পিপিপি তৈরি করতে হবে। সেতু নির্মাণের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন আছে। নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ছাড়া সেতু নির্মাণ করা যাবে না। শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী এই নৌপথটি দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত হলেও এই নদী দিয়ে ছোট ছোট নৌকা ও ট্রলার চলাচল করে। জাহাজ বা কার্গো চলাচল করে না। প্রস্তাবিত সেতুটির ৬হাজার ৮শ' মিটার উজানে একটি ও ৫হাজার ৭শ' মিটার ভাটিতে একটি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ রোড লেভেলে করা হলেও নৌচলাচলে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে না। উচ্চতা কমিয়ে ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আশা করি দ্রুততম সময়ে চৌকিদারফাঁড়ি-নয়াহাট সেতুর ব্যাপারে একটা সমাধান হতে পারে।"

বিআইডব্লিউটিএ চট্টগ্রাম'র নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহমানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "আমি চট্টগ্রামে যোগদান করেছি এক বছর হলো। এরমধ্যে সাঙ্গু নদীর ওপর চৌকিদারফাঁড়ি নয়াহাট সেতুর ক্লিয়ারেন্স সংক্রান্ত কোন প্রস্তাবনা আমার হাতে আসেনি। নৌপথে প্রত্যেকটা নৌযান চলাচল করতে গেলে ব্রিজের ক্লিয়ারেন্স যদি ঠিকমত না থাকে তবে নৌযান চলাচলে সমস্যা হয় ব্রিজের কারণে। নদীর উচ্চতা সম্পর্কে বিআইডব্লিউটিএর মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী কোন নৌপথে কতটুকু উচ্চতার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে তা পূর্ব নির্ধারিত। সেতু নির্মাণের ক্লিয়ারেন্সের ব্যাপারে আমি একা মতামত দেই না। এখানে পোর্ট, নৌসংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ এবং প্রকৌশল বিভাগের সমন্বয়ে ত্রিবিভাগীয় একটা কমিটি আছে। তিন বিভাগের তিনজন প্রতিনিধি সেতু নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত স্থান সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করলে তার আলোকে ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয়। চৌকিদারফাঁড়ি নয়াহাট সেতুর ক্লিয়ারেন্স না পেয়ে থাকলে বিআইডব্লিউটিএর সাথে তারা যোগাযোগ করলে আমরা সরেজমিন পরিদর্শন করে দ্রুত ক্লিয়ারেন্স দেয়ার জন্য প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করবো।"

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড