• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ফেনীতে বাখরাবাদ গ্যাসের অবৈধ সংযোগ থামছেই না

  এস এম ইউসুফ আলী, ফেনী

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৩৩
ফেনী

কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেই, নেই আবেদনও। এরপরও ফেনী শহর সহ জেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বাখরাবাদ গ্যাসের অবৈধ সংযোগ। বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও অসাধু কর্মকর্তা আর একশ্রেণীর ঠিকাদারদের যোগসাজশে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অনুমোদন ছাড়াই অবাধে পুনরায় অবৈধ সংযোগ অব্যাহত রয়েছে।

বিভিন্ন অবৈধ সংযোগ ও অবৈধ জ্বালানী রোধে অভিযান চালানো হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় কতিপয় ব্যক্তিরা অবৈধ সংযোগ দেওয়া শুরু করেন। অনুসন্ধানে এসব চিত্র বেরিয়ে এসেছে।

গত ৮ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার শহরের শাহীন একাডেমী সড়কে বাখরাবাদের অভিযানে স্বর্ণকমল নামে ৬ তলার একটি ভবনে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফেরদৌস আরা বেগমের মালিকীয় ওই ভবনে অনুমোদিত ২ চুলার বিপরীতে জ্বালানো হয় ১০টি চুলা।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর অনুমোদিত দুটি চুলার সংযোগ পাইয়ে দিতে কতিপয় ঠিকাদার লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেন।

টাকা আদায়ের পর ওই ভবনে বিচ্ছিন্ন হওয়া ১০টি চুলা অবৈধভাবে সংযোগ দেয়া হয়। শুধু স্বর্ণকমলই নয়, শহর সহ জেলার বিভিন্ন স্থানে বহুতল ভবনে অবৈধভাবে গ্যাসের সংযোগ দিয়ে মাসিক হারে বিল আদায় করছেন কতিপয় ঠিকাদার।

সংযোগ বিচ্ছিন্ন ভবনগুলোতে এভাবেই সংযোগ দেয়া হয় অহরহ। বাখরাবাদের গুটিকয়েক কর্মকর্তা ম্যানেজ হওয়ায় তারা জেনেও নিশ্চুপ ভূমিকায় রয়েছেন। দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পুন:সংযোগ পেতে কমপক্ষে একমাস সময়ের প্রয়োজন।

সূত্র আরো জানায়, মহিপাল হাউজিং সোসাইটির রাজ্জাক ম্যানশন, চৌধুরী বাড়ী সড়কের ফরাজি বাড়ি সম্মুখস্থ উদয়ন ভবন, ফেনী ইউনিভার্সিটি সম্মুখস্থ জসিম স’মিলের পেছনের ভবন, পাঠানবাড়ী রোডের মমিন জাহান মসজিদ সংলগ্ন ভবন, সালাহ উদ্দিন মোড় এলাকার ভবন, রয়েল হাসপাতাল সংলগ্ন ভবন, ফেনী পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট সংলগ্ন বস্তি, বোগদাদিয়া মীর বাড়ির রাস্তার মাথায় লিজা ফুড ফ্যাক্টরি, বোগদাদিয়া চনাচুর ফ্যাক্টরি সহ আবাসিক এমনকি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও অনুমোদন ছাড়াই ব্যবহার হচ্ছে গ্যাস।

এছাড়া পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কাশিমপুর কামার বাড়ির দরজা, ছাগলনাইয়া পৌর শহরের বাঁশপাড়া এলাকার বেলাগাজী মজুমদার বাড়ী, পশ্চিম বাঁশপাড়া এলাকায়, সদর উপজেলার শর্শদী ইউনিয়নের ফতেহপুরে শত শত ফুট লাইন নির্মাণ করা হয়।

জেলার ৫ উপজেলা এবং নোয়াখালীর বসুরহাট এলাকায় সর্বমোট ৩০ হাজার ৫শ ১৯ জন গ্রাহক রয়েছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ৩৩৩ ও ২৭ জন শিল্প গ্রাহক রয়েছেন।

বাখরাবাদ সূত্র জানায়, গত বছরের জুলাই মাসে 'ফেনীতে বাখরাবাদের গ্যাস হরিলুট’ শিরোনামে স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে তথ্যবহুল সংবাদ প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হয়। এর রেশে জেলায় গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন অভিযান শুরু হয়ে অব্যাহত রয়েছে।

গত বছরের জুলাই থেকে চলিত মাসের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেড়শতাধিক অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। একাধিক অভিযানে গিয়ে বাখরাবাদের প্রধান কার্যালয়ের ভিজিলেন্স টিমও বিস্মিত হন। একাধিক অভিযানে একটি কিংবা দুটির অনুমোদন নিয়ে জ্বালানো হয় ১৮ থেকে ২০টি চুলা।

জানা গেছে, অভিযানের পর থেকে যেসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে সেসব বাসা-বাড়ীতে পুনরায় অবৈধ সংযোগ নেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট অফিস সূত্র জানায়, গত ৯ সেপ্টেম্বর বাখরাবাদের প্রধান কার্যালয় থেকে ২৮.১১.০০০০.৭১২.৪২.০০৮.২০.৩৭ স্মারক আদেশে অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও বিল খেলাপি গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ফেনী জেলায় ৮ সদস্যের দুটি টিম গঠন করেছে।

একটি টিমে ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস শাখা ব্যবস্থাপক মো: সাহাবুদ্দিন এবং অপর টিমে রাজস্ব ও হিসাব শাখার উপ-ব্যবস্থাপক মো: আবুল বসর ভূঞাকে আহবায়ক করা হয়েছে।

মো: সাহাবুদ্দিন নেতৃত্বাধীন টিমে সহকারী প্রকৌশলী কামরুল হাসান, প্ল্যান্ট অপারেটর মো: এনামুল হক ও বিক্রয় সহকারী মো: জামাল উদ্দিন এবং আবুল বসর ভূঞার টিমে সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নুর করিম, টেকনিশিয়ান মো: হুমায়ুন কবীর, টেকনিশিয়ান মো: ওয়াজি উল্লাহ সদস্য রয়েছেন।

সূত্র জানায়, টিম সদস্যদের কেউ কেউ অবৈধ সংযোগ প্রদানের সাথে জড়িত রয়েছেন। তাদের সাথে কিছু ঠিকাদার ও ঠিকাদার সহকারী (ফিটার) রয়েছে। অনেকে জানিয়েছেন, দিনের বেলায় বাখরাবাদের অভিযানে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও এক-দুইদিনের মধ্যে তাদের সহায়তায় পুন:সংযোগ দেয়া হয়।

ইতিমধ্যে মুরাদ নামের একজনকে বাখরাবাদে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাকে বাখরাবাদের অফিসে প্রবেশে মৌখিকভাবে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। একইভাবে বেশ কয়েকজন ঠিকাদার-ফিটার ভিজিলেন্স টিমের নজরদারীতে রয়েছে।

বাখরাবাদের অভিযানকে অনেকটা লোক দেখানো বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গ্রাহকরা। তারা জানান, আমরা বৈধ গ্যাস লাইন নিয়ে নিয়মিত বিল দিয়েও গ্যাস পাই না। বৈধদের গ্যাস শুষে নিচ্ছে অবৈধরা। বক্তব্য জানতে বাখরাবাদ গ্যাসের নোয়াখালী আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো: সোলায়মানকে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

বাখরাবাদের ফেনী এরিয়া অফিসের ব্যবস্থাপক মো: সাহাবুদ্দিন জানান, অবৈধ গ্যাস সংযোগের খবর পেলেই অভিযান চালিয়ে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

এর আগে ২০১৫ সালে জেলার বেশ কিছু অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ২০১৬ সাল থেকে সরকার গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়।

নুরুল হক। সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া বাজার সংলগ্ন মোল্লা বাড়ির বাসিন্দা। গত প্রায় দেড়যুগ আগে বাখরাবাদের দুই চুলার সংযোগ নেন। দীর্ঘদিন বিল বকেয়া থাকায় গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস লিমিটেড কর্তৃপক্ষ।

এরপর বকেয়া বিল পরিশোধের পর বাখরাবাদের নিয়মমাফিক পুন:সংযোগ পেতে আবেদন করেন। এখান থেকেই শুরু হয় হয়রানি। আবেদনের পর ৫-৬ ঘুরেও অফিসের রাজস্ব ও হিসাব শাখায় সংরক্ষণে থাকা নুরুল হকের নথিপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। একপর্যায়ে তিনি বাধ্য হয়ে নতুন নথিপত্র তৈরির জন্য অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়।

বাখরাবাদ গ্যাসের ফেনী এরিয়া অফিসের হয়রানীর এ দৃশ্য প্রতিদিনকার। ৩০ হাজার ৫শ ১৯ জন নিবন্ধিত গ্রাহক থাকলেও প্রয়োজন অনুযায়ী কারো নথিপত্র পাওয়া যায়না।

সংশ্লিষ্ট অফিস সূত্র জানায়, ৪ডি ১৬১১৫, ৪ডি ৬৮৭৩, ৪ডি ২২৭৫৭, ৪ডি ২১৮৫৪, ৪ডি ২১৭৪৮, ৪ডি ২১৩৮৫, ৪ডি ২২৭৫৬, ৪ডি ২২১৪২, ৪ডি ২৬৬৫৯, ৪ডি ১১৩০৭, ৪ডি ১১৯৯৫, ৪ডি ১৯২২৮ সহ অসংখ্য নথিপত্রের কোন হদিস নেই। নথিপত্র সংরক্ষণ না থাকার অজুহাতে অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে কিছু ঠিকাদার ও অফিসে কর্মরতরা নতুন নথি তৈরি করেন।

গ্রাহকরা অভিযোগ করেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থার কার্যক্রম কারো নজরদারীতে না থাকায় বাখরাবাদের কতিপয় লোকজন গ্রাহকদের কাছ থেকে যাচ্ছেতাই টাকা আদায় করে থাকেন। এছাড়া নতুন বিল বই সংগ্রহ করতেও টাকা গুনতে হয়।

বাখরাবাদের ফেনী এরিয়া অফিসের রাজস্ব ও হিসাব শাখার ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান জানান, অফিসে কোন ধরনের লেনদেনের সুযোগ নেই। রশিদ দিয়েই ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা আদায় করা হয়।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড