মো. মুশফিকুর রহমান (রিজভি), সাতক্ষীরা
তিনি ৩৫তম ‘বিসিএস’র একজন শিক্ষা ক্যাডার। প্রভাষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে। অথচ তিনিই দিনের পর দিন, বহু দুপুর-রাত না খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন। রাতে ঘুমচ্ছেন কোনো বাজারের দোকানের বারান্দায় অথবা মসজিদে। এমনও রাত গিয়েছে যে, কোথায় ঘুমবেন রাত ১০ টায়ও তা ঠিক করতে পারেনি। শুনতে অবাক লাগলেও দু’একদিন নয় ৯২টি দিন ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলের মানুষদের পাশে দাঁড়াতে এভাবেই কাটিয়ে দিয়েছেন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের প্রভাষক ইদ্রিস আলী।
ইদ্রিস আলী সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের সুভদ্রাকাটী গ্রামের সুলতান সরদারের ছেলে। অনবরত মানবিক কাজ করার কারণে ইতিমধ্যেই তিনি ‘মানবিক প্রভাষক’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
সম্প্রতি প্রলয় সৃষ্টিকারী ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ এ ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে দাঁড়িয়েও মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন ইদ্রিস আলী। তার সংগঠন ‘হিউম্যানিটি ফাস্ট’ এবং তিনি কাজ করেছেন সামনে থেকে। গিয়েছেন আম্ফান দুর্গত দক্ষিণ অঞ্চলের সব জায়গাতেই। খাবার পৌঁছে দিয়েছেন উপকূলের ৮ সহস্রাধিক পরিবারের মাঝে। ৪০ জন শিশুদের প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত দুধ কিনে দিয়েছেন এবং এখনও দিচ্ছেন। আম্ফানে গৃহহীন ৮টি পরিবারকে গৃহ নির্মাণ করে দিয়েছেন এবং গৃহ নির্মাণ চলমান রয়েছে আরো ১০টি। পানির সঙ্কটে থাকা উপকূলবাসীর জন্য স্থাপন করেছেন ৬টি গভীর নলকূপ, আরো ৫টি গভীর নলকূপ স্থাপন প্রক্রিয়াধীন আছে।
এছাড়াও আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলের কয়েকটি স্কুলে অর্ধশতাধিক বৃক্ষরোপণ এবং ৫জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন ইদ্রিস আলীর সংগঠন হিউম্যানিটি ফাস্ট। নতুন করে তারা বানভাসি মানুষদের জন্য ১শ টি পরিবেশ বান্ধব চুলা বিতরণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন।
এখানেই থেমে যাননি ইদ্রিস আলী ঈদ বাজার, নতুন পোশাক, কুরবানির মাংসও পৌঁছে দিয়েছেন আম্ফানে সহায়-সম্বল হারানো মানুষদের কাছে। স্যানিটারি ল্যাট্রিন নির্মাণ, অস্থায়ী ঘরের জন্য বাঁশ-খুঁটি প্রদান আবার কোথাও হাজির হয়েছেন প্রয়োজনীয় ঔষধ ও খাবার স্যালাইন নিয়ে।
ভাসমান পানিবন্দী মানুষকে অসুস্থতায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, বাঁধে বস্তা-বাঁশ কিনে দেওয়া আবার কখনও নিজেই শ্রম দিয়েছেন বাঁধ সংস্কার কাজে। রিংবাঁধে শ্রম দেওয়া মানুষদের খাবারের ব্যবস্থাও করেছেন। পানি সংকটে থাকা মানুষদের জন্য করেছেন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ। আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত মসজিদ সংস্কারেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন এই মানবিক প্রভাষক।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফান পরবর্তী ৯২ দিন এসব কাজ করেই কেটেছে তার। এই ৯২ দিনের মধ্যে কয়েকবার জেলা শহরে এসেছিলেন পরিবারের কাছে কিন্তু নদীতে পানির উচ্চতা বেড়েছে শুনে আর থাকা হতনা আবার ফিরে গেছেন উপকূলের বানভাসি মানুষের কাছে।
ইদ্রিস আলী ‘দৈনিক অধিকার’কে বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ আমাদের প্রতি আস্থা রেখে উপকূলের বিপন্ন মানুষদের জন্য তাদের ভালবাসার উপহার পাঠিয়েছেন। আমরা স্পটে গিয়ে সেসব উপহার পৌঁছে দিয়েছি আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে।
তিনি আরো বলেন, আম্ফান এলাকা ছেড়ে যেই না কংক্রিটের শহরে গিয়েছি মনটা পানিবন্দী মানুষের জন্য ছটফট করেছে। নদীতে পানির উচ্চতা বেড়েছে শুনলে আর থাকা হতনা শহরে। উপকূলের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠলেই কোথা থেকে কে যেন এক রাশ শান্তির পরশ বুলিয়ে যেত।
‘আম্ফান’র দিনগুলির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, কাঁধে একটি ব্যাগে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে একবার যে বেরিয়েছি, কবে বাসায় ফিরব, তা ঠিক করে বাবা-মা, স্ত্রী-কন্যা বা বন্ধু-বান্ধব কাউকেই বলতে পারিনি।
গত ১৩ আগস্ট ৯২ দিনের উপকূল সেবা শেষ করে সাতক্ষীরা শহরে পরিবারের কাছে ফেরেন প্রভাষক ইদ্রিস আলী। কিন্তু কয়েকদিন না যেতেই বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে আবার ছুটে গেছেন আশাশুনি উপজেলায়। এর পর থেকে নিরন্তর ছুটে চলেছেন ক্ষতিগস্থ অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে। নিজের মাথায় শুকনা খাবারের বস্তা নিয়ে পানির মধ্য দিয়ে কয়েক কিলোমিটার হেটে পৌঁছেছেন নদী ভাঙনে গৃহহীন হয়ে পড়া মানুষদের পাশে। তাদের জন্য শুকনা খাবারের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব চুলা এবং রান্নার জন্য চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য পৌঁছে দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন : একজন মানবিক প্রভাষকের গল্প
প্রভাষক ইদ্রিস আলী জানালেন, উপকূলের ভাগ্যহত মানুষের মুখে হাসির রেখা না দেখে শহরে গিয়ে তিনি শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন না।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড