ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) বিরুদ্ধে ৩০ লাখ টাকার করোনা সুরক্ষা সামগ্রী এবং শিশু খাদ্য ক্রয় ও বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
এর মধ্যে করোনা সুরক্ষা সামগ্রী ১৩ লক্ষ টাকা এবং শিশু খাদ্য ও আর্থিক সহায়তায় সাড়ে ১৬ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক মহলে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। নামকা ওয়াস্তে কিছু বিতরণ করা হলেও বেশির ভাগ মানুষই জানে না এসব সামগ্রী কোথায় কাকে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এত বিপুল অংকের টাকার সামগ্রী কোথায় বিতরণ করা হয়েছে? এ প্রশ্ন সর্বত্র।
অভিযোগ কাগজপত্রেই সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণের হিসেব দেখিয়েছেন ইউএনও। এদিকে অনিয়ম হয়েছে বুঝতে পেরেও আখাউড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এসব বিলে স্বাক্ষর করছেন বলে চেয়ারম্যান নিজেই স্বীকার করেছেন। তবে ইউএনও তাহমিনা আক্তার রেইনা দাবি করেছেন স্বচ্ছতার সঙ্গেই তিনি এ টাকা খরচ করেছেন এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শ করেই সব করেছেন।
ইউএনও অফিস সূত্রে জানা যায়, গত সাড়ে ৩ মাসে শিশু খাদ্য, নগদ অর্থ, মাস্ক, পিপিই, গ্লাভস, স্যানিটাইজারসহ মোট ৩০ প্রকার সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করা হয়। এসব সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় বাবদ উপজেলা উন্নয়ন তহবিল থেকে ১২ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা এবং জেলা প্রশাসকের ফান্ড থেকে শিশু খাদ্য ও নগদ সাড়ে ১৬ লক্ষ টাকা অর্থ সহায়তা দেওয়া হয় । এর মধ্যে শিশু খাদ্য বাবদ ১ হাজার ৬১১জনকে ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার এবং নগদ অর্থ সহায়তা ৫ হাজার ৬৬৫ জনকে ১১ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে করোনা সুরক্ষা সামগ্রীর মধ্যে দেড় লক্ষ টাকায় ৫ হাজার মাস্ক, ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকায় ৪ হাজার গ্লাভস, প্রায় ৮০ হাজার টাকায় স্যানিটাইজার ক্রয় করেন। সুরক্ষা সামগ্রীর তালিকায় আরও রয়েছে চশমা, ক্যাপ, সু-কভার, ফেস কভার, অ্যাপ্রোন।
তালিকায় রয়েছে হাসপাতালের ব্যবহার্য ভ্যাকুয়াম টিউব, সপ স্টিক, ওটি গ্রাউন্ড, ডিজিটাল থার্মোমিটার। এছাড়া প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ব্যয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ২৬টি হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপন করা হয়। তবে সরজমিনে বেসিনগুলো ব্যবহার অনুপযোগী অবস্থায় পাওয়া যায়।
বিষয়টি জানার জন্য সাংবাদিকরা আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিনা আক্তার রেইনার কাছে গেলে তিনি সব কিছু নিয়ম মাফিক করেছেন দাবি করে মালামাল ক্রয়ের একটি ইস্টিমেটের কপি সাংবাদিকদের দেন। ওই ইস্টিমেটে ১৭ টি আইটেম উল্লেখ থাকলেও কোন আইটেম কতগুলো কেনা হয়েছে সঠিক হিসাব এবং এসব মালামালের বিল ভাউচার দেখাতে ব্যর্থ হন ইউএনও।
২ দিন পর উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার অফিসের সার্ভেয়ার মো. জহুরুল ইসলামের মাধ্যমে ৩০ প্রকার সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ের একটি তালিকা পাঠান। যার সঙ্গে ইস্টিমেটের কোনো মিল পাওয়া যায়নি।
আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ‘ইউএনও স্যার আমাকে ৫০টি মাস্ক ও ২০ জোরা গ্লাভস দিয়েছে। এছাড়া আর অন্য কিছু পাইনি।’
আখাউড়া মনিয়ন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কামাল ভূইয়া বলেন, ‘ইউএনও স্যার আমাকে কিছু ব্লিচিং পাউডার দিয়েছিলো। এছাড়া আর অন্য কিছু পাইনি আমি।’
আখাউড়া উপজেলা এলজিইডির সার্ভেয়ার জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘এত টাকার সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করা হলো কিন্তু আমি নিজেই কিছু পাইনি।’
এদিকে ইউএনওর দেওয়া ইস্টিমেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৩ মার্চ করোনা সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ের ইস্টিমেট করা হয়। ১৫ মার্চ ওই ইস্টিমেটে ইউএনও স্বাক্ষর করেছেন। আখাউড়ায় তখনও করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি। ৯ এপ্রিল আখাউড়ায় প্রথম করোনা উপসর্গ ধরা পড়ে। করোনা শনাক্তের আগেই তিনি কিভাবে ইস্টিমেট করলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও প্রথমে কোন সদুত্তর দিতে না পারলেও পরে বলেন এটা ক্লারিকেল মিসটেক।
আখাউড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন বেগ শাপলু বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জীবাণুনাশক স্প্রে করেছে। মাস্ক বিতরণ করেছে। প্রশাসনকে কোথাও করোনা সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করতে আমরা দেখিনি। আমি নিজেও করোনা আক্রান্ত হয়েছিলাম আমাকেও কিছু দেওয়া হয়নি।’
আখাউড়া উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক আব্দুল মমিন বাবুল বলেন, ‘করোনা দুর্যোগের সময়ে যুবলীগের পক্ষ থেকে মাস্ক, স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে। শ্রমিক সংকটে জমি থেকে কৃষকের ধান কেটে দিয়েছে। ইউএনও কোথায় কতগুলো মাস্ক, স্যানিটাইজার, পিপিই বিতরণ করেছেন তা আমি জানি না। যুবলীগকে এসব কোনো সুরক্ষা সামগ্রী দেননি।’
আখাউড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা প্রাদুর্ভাবের মাঝে সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছে। প্রশাসনের কাছ থেকে সাংবাদিকরা কোনো সুরক্ষা সামগ্রী পায়নি।’
আরও পড়ুন : ৩০ জনকে দাফন-কাফন করে করোনায় আক্রান্ত ইয়াছিন
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ রাশেদুর রহমান বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন থেকে কিছু করোনা সুরক্ষা সামগ্রী পেয়েছি।’ তবে তিনি কী পরিমাণ সামগ্রী পেয়েছেন তা সাংবাদিকদের জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিনা আক্তার রেইনা বলেন, ‘সুরক্ষা সামগ্রীর মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাস্ক, পিপিসহ অন্যান্য সামগ্রী বেশি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদে মাস্ক-স্যানিটাইজার, গ্লাভস দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।’
আখাউড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাসেম ভূইয়া বলেন, ‘আমি বলেছিলাম ৪/৫ লক্ষ টাকা খরচ করতে। কিন্তু ইউএনও ইচ্ছেমতো এতগুলো টাকা খরচ করেছেন। বিল ভাউচার ঠিক না থাকায় আমি প্রথমে এ টাকা অনুমোদনে স্বাক্ষর করিনি।’ পরে চক্ষু লজ্জায় স্বাক্ষর করেছেন বলেও জানান তিনি।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড