• বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বিপৎসীমার উপরে যমুনার পানি

জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, ত্রাণের জন্য হাহাকার

  জামালপুর প্রতিনিধি

২৫ জুলাই ২০২০, ২০:৫৬
বন্যা
জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, ত্রাণের জন্য হাহাকার (ছবি : সংগৃহীত)

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বর্ষণে যমুনার পানি বেড়ে জামালপুরে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়ে। জেলার সাত উপজেলার ৮টি পৌরসভা ও ৬৮ ইউনিয়নের মধ্যে এখন পানিবন্দি ৬০টি ইউনিয়নের ১০ লাখ মানুষ। একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে আঞ্চলিক ও স্থানীয় সড়ক যোগাযোগ।

এ দিকে, পানি বাড়ার সাথে সাথে দুর্গম চরাঞ্চলে গরু-বাছুরসহ বিভিন্ন পশু চুরির আতঙ্কে রাত কাটছে কৃষকের। একই সঙ্গে তীব্র খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে বানভাসিরা। এছাড়া ইতোমধ্যেই বন্যার পানিতে ডুবে ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

অন্যদিকে, যমুনা নদীর পানি তৃতীয় দফায় শনিবার (২৫ জুলাই) সকালে ৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাইসহ অন্যান্য শাখা নদীর পানির বৃদ্ধিও অব্যাহত রয়েছে।

সবমিলিয়ে সাত উপজেলায় বন্যার ভয়াবহ অবনতি দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়েই চলছে। এরই মধ্যে ১৩ হাজার হেক্টর বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, গো চারণ ভূমি, বসতবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ গ্রামীণ হাট-বাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ১৭শ কিলোমিটার সড়ক পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়াও দুর্গত এলাকায় গো খাদ্যের সংকটের পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ।

যমুনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলসহ দুর্গত এলাকায় চারদিকে পানি থাকায় বসতবাড়ি ফাঁকা হয়ে গেছে। ফলে যে যার মতো করে পরিবারের জীবন বাঁচানোর জন্য বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ উঁচু সড়কে কেউবা বাঁধে-ব্রিজে আবার কেউ ঠাঁই নিয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। যে যার মতো বিচ্ছিন্ন স্থানে গৃহপালিত পশুপাখি রেখে দিয়েছে। তবে দিনের বেলায় পশুর কাছাকাছি থাকলেও সন্ধ্যার পর চারদিকে অন্ধকার থাকায় চরম আতঙ্কে দিন পার করতে হচ্ছে কৃষকদের।

বিশেষ করে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর। চারিদিকে ফুলে ফেঁপে উঠা পানিতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে জেলার অধিকাংশ লোক। গরুর কাঁচা ঘাস, শুকনো খর ও চারণ ভূমি পানিতে নিমজ্জিত থাকায় কৃষকের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ইদুল আযহাকে সামনে রেখে যারা গরু পালন করছিল তারাও এবার লোকসানের মুখে পড়েছে।

ইসলামপুর পার্থশী ইউনিয়নের দর্জিপাড়া এলাকার বেলে বেগম স্বামী মারা গেছে বছর তিন হলো। সংসারে এক মেয়ে আর একমাত্র সম্বল একটি ছাগল নিয়ে তার অভাবের প্রিয় সংসার কোনোমতো চলছিল। কিন্তু বন্যায় ঘরে পানি উঠায় আশ্রয় নিলেও প্রিয় সন্তান আর ছাগলের খাবার নিয়ে চরম সংকটে পড়ছেন তিনি। পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়া জন্য পানিতে ভিজে ঘুরেও ত্রাণের সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

চিনাডুলি ও পার্থশী ইউনিয়নের সীমানা ঘেঁষা আমতলী বাজারের মুদি দোকানি শামিম আকন্দ। ১৯ দিন ধরে বাজারে পানি উঠায় ক্রেতাশূন্য হয়ে পরেছেন তিনি। ফলে ছেলে-মেয়ে ও বৃদ্ধ মায়ের মুখে খাবার দিতে না পারায় ত্রাণের জন্য হাত বাড়িয়েছিলেন চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে। কিন্তু রিলিফের ১০ কেজি চাল তার ভাগ্যে জোটেনি। পরে সড়কে খোলা আকাশের নিচে কোনোমতো দোকান নিয়ে বসলেও বেচা-বিক্রি নেই বলে জানান তিনি।

এ দিকে, জেলার ইসলামপুর উপজেলার পার্থশী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম ঢেংঙ্গারগড়ের খলিশাগুড়ি, দর্জিপাড়া সুরের পাড়া, নবকুড়ায় প্রায় ৫ হাজার লোকের বসবাস। এই এলাকার বৃহৎ একটি অংশকে বাদ দিয়ে সামান্য ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গ্রামেগুলোতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি থাকায় বন্যায় চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিন পার করছে মানুষ।

অন্যদিকে, ৭ নম্বর পার্থশী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার রেজাউল করিম রাজা জানান, আমার ওয়ার্ডে অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। এখানে ৩টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বর্তমানে এখানে আশ্রয় নিয়েছে ১২০ জন বানভাসি মানুষ। ২৮ দিনের বন্যায় ত্রাণের বরাদ্দ এসেছে ৩০০ জনের ১০ কেজি চাল। বড় একটি অংশকে ত্রাণের আওতায় না আনতে পারায় খাদ্য সংকট চরমে উঠেছে। সরকারের কাছে আমার আবেদন নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে ত্রাণ বরাদ্দ দিয়ে মানুষকে এই সংকট থেকে উত্তোলন করুন।

জামালপুরের পুলিশ সুপার মো. দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে করোনা ও বন্যা এই দুই মহামারিতে জামালপুর জেলার মানুষ চরম সংকটের মধ্যে দিন পার করছে। জেলা পুলিশ বন্যা কবলিত এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় তিন শিফটে নৌ-টহল বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে একটি ফোন নাম্বার দেওয়া আছে, কোনো প্রকার সমস্যা দেখা দিলে পুলিশকে কল করার সাথে সাথে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবে। তবে এখন পর্যন্ত জেলায় কোনো অপ্রতিকর ঘটনা ঘটেনি বলেও জানান তিনি।

বিষয়টিতে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নায়েব আলী দৈনিক অধিকারকে জানান, জেলায় ৬০টি ইউনিয়নের ৬৭৭টি গ্রামের ২ লাখ ৭০ হাজার পরিবারের প্রায় ১০ লাখ মানুষ বর্তমানে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানির স্রোতে ১৪ হাজার ৫শ বসতবাড়ি আংশিক ও পুরোপুরি ভেঙে গেছে। দুর্গতদের জন্য এখন পর্যন্ত ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৮৮৪ মেট্রিক টন চাল, নগদ ২৯ লাখ টাকা, শিশুখাদ্য ২ লাখ ও গো খাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা। এছাড়া প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রে উপস্থিত সকলের মাঝে শুকনো খাবার ও খিচুড়ি বিতরণ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন : শেরপুরে বন্যায় পৃথক ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু

এ ব্যাপারে জামালপুরের স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশলী অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মো. সায়েদুজ্জামান সাদেক দৈনিক অধিকারকে জানান, ভয়াবহ বন্যার কারণে আমাদের বিভাগের প্রায় ১৭শ কিলোমিটার সড়ক পানিতে তলিয়ে আছে। কয়েকটি ছোট-বড় ব্রিজ আংশিক ও পুরোপুরি ক্ষতি হয়েছে। পানির প্রচণ্ড স্রোতের কারণে জেলার অধিকাংশ সড়কের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। তবে পানির পরিমাণ কমে গেলে ক্ষতির সঠিক পরিমাণ জানা যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক জানান, বন্যা মোকাবিলায় প্রশাসনের সবধরনের প্রস্তুতি আছে পাশাপাশি ত্রাণের কোনো কমতি নেই। এখন ২০০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও গো খাদ্যে জন্য ২ লাখ টাকা মজুদ রয়েছে। এছাড়া তার উদ্যোগে প্রতিদিন বন্যার্তদের মাঝে ৪ হাজার পিস রুটি তৈরি করে বিতরণ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ত্রাণ পাবার যোগ্য সকলেই পাবে, কেউ বাদ পড়বে না। যেহেতু চারিদিকে পানি আর দুর্গম এলাকা তাই ত্রাণ পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগছে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড