মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস মহামারির সময় নতুন আতঙ্ক যুক্ত হয়েছে নদী ভাঙন। আর এই আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার পদ্মা পাড়ের মানুষের। উপজেলার দিঘীরপাড় , কামারখাড়া ও পাঁচগাও ইউনিয়নের প্রায় ৫ কিলোমিটার জুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদী ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে নদীর দু'পাশের শত শত পরিবার। ভাঙন দুশ্চিন্তায় দিশেহারা তারা। গত কয়েকবছর ধারাবাহিক ভাঙনে পথে বসেছে অন্তত দুই শতাধিক দরিদ্র পরিবার। নদীতে বিলীন হয়েছে বসত বাড়ি, কৃষি জমি, মসজিদ, কবরস্থান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয়রা জানায়, উত্তর অঞ্চলের বন্যার পানি উপজেলার পদ্মা নদী হয়ে দক্ষিণাঞ্চল দিকে যাচ্ছে। এসময় নদীতে তীব্র ঘূর্ণি স্রোত তৈরি হয়েছে। এর ফলে প্রতিবছর এ সময় নদী ভাঙন শুরু হয়। এতে উপজেলার দিঘীরপাড় ইউনিয়নের হাইয়ারপাড়, সরিষাবন, ধানকোঁড়া, মূলচর, কামারখাড়া ইউনিয়নের বাগবাড়ি, ভাঙুনিয়া ও পয়সাগাঁও এবং পাঁচগাঁও ইউনিয়নের গাড়ুগাঁওসহ তিনটি ইউনিয়নের ৮ টি গ্রাম একটু একটু করে নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বসতভিটা হারিয়ে সড়কের পাশে মানবেতর জীবনযাপন করছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। পাশাপাশি ভাঙনে ফসলি জমি বিলীন হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি।
তাদের অভিযোগ প্রতি বছর একরের পর একর জমি বিলীন হচ্ছে পদ্মায়। ভাঙছে বসত ভিটা।তবুও ভাঙন কবলিত মানুষদের রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোন জোড়ালো ভূমিকা নিচ্ছেনা। প্রতি বছর ভাঙনের সময় আশ্বস্ত করা হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছেনা।
সরেজমিনে গত কাল রোববার সকালে হাইয়ারপাড় এলাকায় দেখা যায়, পদ্মার ভাঙনের মুখে হেলে পড়েছে আল মদিনা জামে মসজিদ। যেকোনো সময় নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে মসজিদটি। এর আশপাশে নদী তীরবর্তী এলাকাও ভেঙে পড়ছে।
আব্দুর রহমান নামে এক ব্যক্তি বলেন, গত বছর নদী ভাঙনের ফলে এ এলাকার ২৫ টি বসত ভিটা নদী গর্ভে বিলীন হয়। এছাড়া এ বছর পদ্মার গর্ভে রসিদ শেখ, জুলহাস শেখ, ওয়াসিম শেখ, সায়েদ হালদার, ইদ্রিস হালদার ও সোহেল শেখসহ ১৫ জনের বসতভিটা নদীতে ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে। তবে এ মসজিদটি টিকে ছিল। এখন ধীরে ধীরে সেটিও পদ্মায় বিলীন হতে চলেছে।
গত বছরের নদী ভাঙনের শিকার হওয়া হাইয়ারপাড় এলাকার সাহা-আলম হালদার, ইকবাল হালদার, মিন্টু হালদার, সুমন হালদার, আবু বাক্কার হালদার, মহিউদ্দিন হালদার, সূর্যত আলি বেপারি, করিম হালদার, রহিম হালদারা বলেন, নদীটি গত ১৫ বছর আগেও বর্তমান নদীর অবস্থান থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে ছিল। তখন এটি ২০-২৫ ফুট চওড়া ছোট একটি খালের মত ছিল। এটি পদ্মার খাল নামে পরিচিত ছিল। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙন শুরু হয়। দু'পাশ ভেঙে এতে নদীটি এখন ৪শ মিটার চওড়া হয়েছে। প্রশাসনকে অবহিত করলেও রাতের আধারে চলছে বালু উত্তোলন।
ভাঙনের শিকার রসিদ শেখ বলেন, দু’বছর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড সহ সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি দপ্তরে ভাঙন রোধে চিঠি পাঠানো হয়। তবে ভাঙনরোধে এখানো এ এলাকায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, মাস খানেক আগে ভাঙনরোধে তাদের এলাকায় একটি সভা হয়। সেখানে উপজেলার চেয়ারম্যান জগলুল হালদার ভূতু জানান, ’ভাঙন রোধে ৫৫ লক্ষ টাকার জিওব্যাগ ও ৩০ হাজার মেহগনি গাছ প্রয়োজন । সরকার থেকে হোক বা যেভাবে হোক সে ব্যবস্থা করে দিবো । বিনিময়ে হাইয়ারপাড় ও মূলচরের মানুষ গাছ বাবদ ১৫ লক্ষ টাকা দিতে হবে।’ পরবর্তীতে হাইয়ারপাড়ের মানুষ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তাই এই গ্রামটিকে বাদ দিয়ে অন্য স্থানে জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
এ দিন দুপুরে উপজেলার ধানকোঁড়া এলাকায় দেখাযায়, সেখানকার সামাজিক কবরস্থানটি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে । ভাঙন কবলিত কবরস্থানে মাত্র একটি কবর টিকে রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ওই অবশিষ্ট কবরটিও পদ্মার বুকে বিলীন হয়ে যাবে।
এছাড়া পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে সরিষাবন এলাকার মিজান শেখ, আলমগীর শেখ, রহিম শেখ, হুমায়ন শেখ, আজিজ বেপারি, সালাম মিঝি সহ প্রায় ২০টি বসতবাড়ি ও কৃষি-জমি। ঘর ভাঙা এসব মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সড়কের পাশে। কেউ বা অন্যের জমি বাৎসরিক হিসেবে ভাড়া নিয়ে। তবে এখনো তারা নতুন করে কেউ ঘর তুলতে পারেনি।
সরিষাবন এলাকার মিজান শেখ বলেন মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে তারসহ এ গ্রামের ২০ থেকে ২৫ টি বসতভিটা, কবরস্থান, ফসলি জমিসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়েছে। মাথাগোঁজার ঠাঁই হলেও অনেকেই রাস্তার ধারে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
ধানকোঁড়া এলাকার আলমগীর বলেন, প্রতিবছর তাকে ভাঙন কবলে পড়তে হচ্ছে। এর ফলে একেবারেই নিঃস্ব হয়েছে সে। এ পর্যন্ত সরকারি সহযোগিতা বলতে কয়েক প্যাকেট বিস্কুট পেয়েছেন তিনি।
ওই এলাকার লাহেলা বেগম বলেন, এ নিয়ে ২০ বার ভাঙনে পড়েছেন তিনি । প্রতি বছরই ঘরদোয়ার ভাঙতে হচ্ছে। ঘরের দুইটা চালই তাদের সম্পদ। তিনি আবেগের সাথে বলেন,আমরা বাঁচতে চাই বাজান। কিছু একটা দিয়ে ভাঙন বন্ধ করেন। ভাঙন রোধে সরকার কত জায়গায় কত কাজ করছে। তাদের জন্য কেন কিছু করছেনা?
অন্যদিকে, কামারখাড়া ও হাসাইল-বানারী ইউনিয়নের একমাত্র সংযোগ সড়কটির ভাঙুনিয়া এলাকায় পদ্মার পানির স্রোতে ভেঙে গেছে। এছাড়া ভেঙে গেছে দিঘীরপাড় ও রাজাবাড়ি চরের সড়কটিও । এতে করে দুই সড়কে যাতায়াতকারী ১২ গ্রামের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে।
কামারখাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন হালদার বলেন, ভাঙন কবলিত এলাকা গুলোর জন্য জিও ব্যাগ দিচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যাদের কাছ থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান জগলুল হালদার ও তার ছেলে আরিফ হালদার টাকা নিতে পেরেছেন ,সেখানে ব্যাগ ফেলছে। যারা টাকা দেইনি তাদের বাড়ি- ঘর নদীতে বিলীন হচ্ছে। উপজেলা চেয়ারম্যান জগলুল হালদার বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে মাত্র তিনশ মিটার জিও ব্যাগ পেয়েছেন সেটা দিঘীরপাড় বাজারে ফেলেছেন। হাইয়ারপাড় এলাকা ভাঙবেনা, তাই সেখানে ব্যাগ ফেলা হবেনা। তবে তিনি বলেন, হাইযারপাড় ছাড়া সরিষাবন, গারুগাও, দিঘীরপাড়ে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে।সেখানে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ প্রয়োজন।
মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, সাময়িক ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলা হবে। স্থায়ী সমাধানের জন্য পদ্মা সেতুর যে স্থানে নদী শাসন শেষ হয়েছে। সেখান থেকে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার দিঘীরপাড় পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার এলাকায় স্থানীয় ভাবে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। এ জন্য প্রায় ৫শ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার গুলোর জন্য ১৫ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সেটিও যাচাই করে দেখা হবে।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড