• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

কিশোরী গৃহবধুর রহস্যজনক মৃত্যু

প্রতারক স্বামীর কাছে হেরে গেলো কুমারখালীর রিশিতা!

পরিবারের দাবি- হত্যা

  মনিরুল ইসলাম মনি

২৮ জুন ২০২০, ১৯:২৬
নববধু রিশিতা
বিয়ের দিন স্বামী রাকিবুলের সঙ্গে নববধু রিশিতা (ফাইল ছবি)

‘আপনার মেয়ে (রিশিতা) আমার ঘাড়ের বোঝা হয়ে গেছে। তাই আপনার মেয়েকে দিলে একেবারেই দিয়ে দিব’- কথাগুলো রিশিতার মা জলি খাতুনকে মৃত্যৃর ঠিক একদিন আগে মোবাইল ফোনকলে বলেছিল জামাই রাকিবুল ইসলাম রকি। অথচ সাতমাস আগেও রিশিতার প্রতি কী ভালোবাসাটাই না জমেছিল প্রতারক রাকিবুলের হৃদয়-মননে।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রিশিতা। এ সময় উচ্চ শিক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা থাকলেও সহপাঠি রাকিবুল ইসলামের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে কিশোরী রিশিতার। বয়:সন্ধিকালের আবেগ ধরে রাখতে না পেরে তাদের গোপন প্রেমের কথা বন্ধু ভেবে মাকে জানায় রিশিতা। তাদের বিয়ের জন্যও মাকে চাপ দেয়। প্রথমে মা বোঝানোর চেষ্টা করলেও অবুঝ রিশিতার পাথররূপী মন থেকে যেন প্রতিবিম্ব হয়ে ফিরে আসে মায়ের কথাগুলো।

এদিকে, বিয়ের জন্য রিশিতাকে একপ্রকার মানসিক চাপে ফেলে প্রেমিক কুমারখালীর সদকী ইউনিয়নের উত্তর মূলগ্রামের গাফ্ফার মোল্লার ছেলে রাকিবুল। অনেকটা ছেলে পক্ষের চাপাচাপিতেই রিশিতা-রাকিবুলের প্রেম পরিণত হয় শুভ পরিণয়ে। অবশেষে দুই পরিবারের মতেই দেওয়া হয় বিয়ে।

শ্বশুর-শ্বাশুরিকে নিয়ে ভালোই চলছিল রিশিতা-রাকিবুলের ছোট্ট সংসার। এর মাঝে ঘষেটি বেগম হয়ে আর্বিভূত হয় ভাসুর শরীফুল ও তার বউ সীমা! রিশিতার ওপর শ্বশুর-শ্বাশুরির অতিরিক্ত আদর সহ্য হচ্ছিল না শরীফ-সীমা দম্পতির। জের- বিয়ের একমাসের মধ্যেই অশান্তি সৃষ্টি হয় রিশিতার সংসারে।

কিশোরী রিশিতা (ফাইল ছবি)

অনুসন্ধানে এমনটিই উঠে আসে কিশোরী গৃহবধু রিশিতার রহস্যজনক মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে দৈনিক অধিকারের এক অনুসন্ধানে।

এদিকে মৃত্যুর শুরু থেকেই রিশিতার পরিবার বলে আসছে- এটি আত্নহত্যা নয়- এটি পরিকল্পিত হত্যা। তাদের মেয়েকে নির্যাতন করে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সদকী ইউনিয়নের উত্তর মুলগ্রামে। নিহত কিশোরীর বাবা রিকু পারভেজ একই উপজেলার কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা।

রিশিতার বাবা রিকু পারভেজ দৈনিক অধিকারকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) মেয়ে আমাকে ফোন দিয়ে তার শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনের কথা বলে এবং শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে নিয়ে আসতে বলে। পরে শুক্রবার (১৯ জুন) নববধূর মা শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েকে আনতে গেলে মেয়ের শ্বশুর গাফফার মোল্লা ২/৩ দিন পর মেয়েকে দিয়ে যাবেন বলে আশ্বাস দেন।’

রিশিতার মৃত্যু হত্যা নাকি আত্মহত্যা?

রিশিতার মা জলি খাতুন দৈনিক অধিকারকে বলেন, ‘ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার (২০ জুন) সকালে জামাই রাকিবুল রিশিতাকে মারপিট করে। মারপিটের এক পর্যায়ে কিশোরী রিশিতা আমার বাড়িতে চলে আসার জন্য পাথরবাড়িয়া কবরস্থান পর্যন্ত চলেও আসে। কিন্তু রাকিবুল ও তার ভাই শরিফুল পথের মাঝ থেকে তাকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। তাকে পুণরায় শারীরিক নির্যাতন করে এবং হত্যা করে ঘরের আড়ার কাঠের সাথে ঝুলিয়ে রাখে।’

তবে মৃত্যুর দিন শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি চলে আসার চেষ্টাকে অস্বীকার করেন রাকিবুলের চাচাতো ভাই মিজানুর রহমান।

রিশিতার মায়ের বক্তব্যের সত্যতা জানতে রাকিবুলের বাড়িতে যাওয়ার সাথেই সাথেই এই প্রতিবেদককে দেখে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় রাকিবুলের বড়ভাই শরীফুল ও তার স্ত্রী সীমা খাতুন। পেছন থেকে জোরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ফিরে আসতে বললেও তারা পাশের পাটক্ষেতের মধ্য দিয়ে পালিয়ে যায়।

তার পর ওই বাড়িতে কাউকেই পাওয়া যায়নি। তবে কথা হয় রাকিবুলের প্রতিবেশি ও চাচাতো ভাই মিজানুর রহমানের সঙ্গে। রিশিতা আত্মহত্যা করেছে বলে তিনি নিশ্চিত বলে জানান। একই বক্তব্য তার স্ত্রী ইভা খাতুনেরও।

পরে এই প্রতিবেদককে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য চাপাচাপি করেন রাকিবুলের চাচাতো ভাই মিজানুর। টাকাটা নিয়ে এ সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন না করতেও অনুরোধ করেন তিনি।

খোঁজ নেওয়া হয় রাকিবুলের প্রতিবেশিদের কাছেও। তাদের অনেকেই কথা বলতে অস্বীকৃতি জানালেও কয়েকজন দিলেন চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের ভাষ্য- রিশিতা আত্মহত্যায় করেছে। তবে আত্মহত্যা করাতে বাধ্য হয়েছে। বিয়ের এক সপ্তাহ পর রিশিতার বাবার দেওয়া স্বর্নের চেইনটিও বিক্রি করে দেয় স্বামী রাকিবুল। আর প্রতিদিনই অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতেও শুনেছেন তারা। বিয়েতে পাত্রপক্ষের ২০ জন লোক যাওয়ায়- পরে দাওয়াত দিয়ে ৩০০ জনকে খাওয়ানোর জন্যও চাপ দেয় রিশিতার দেবর শরীফুল।

শ্বশুর-শ্বাসুরির রিশিতাকে ভালো চোখে দেখলেও বড়ভাই ও ভাবীর প্ররোচনায় পাষণ্ড হয়ে যান এক সময়ের রোমান্টিক প্রেমিক রাকিবুল! তবে ঘটনার পর থেকেই তারা ঘরছাড়া হলেও গত ২২ জুন তারা আবার বাড়িতে অবস্থান নেয়। শুধু পুলিশ আসলেই পালিয়ে যায় তারা- এমন দাবিই প্রতিবেশিদের।

আরও পড়ুন- বিয়ের দিনে মৃত্যু! কনের শেষকৃত্য করে বাড়ি ফিরলেন বরযাত্রীরা

এ ব্যাপারে কথা হয় কুমারখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মজিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি দৈনিক অধিকারকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এটি আত্মহত্যা। তবে লাশের ময়না তদন্তের প্রতিবেদন আসার পর জানা যাবে হত্যা না আত্মহত্যা। আর যদি এটি আত্মহত্যায় হয়- তাহলে খতিয়ে দেখা হবে আসলে আত্মহত্যা আসলে কী কারণে করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ এটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব নিয়ে তদন্ত করছে। আশা করি মৃত্যু ওই কিশোরীর পরিবার সঠিক বিচারটিই পাবে। এ ঘটনায় জড়িতরা যত প্রভাবশালীই হোক না কেনো পুলিশ তাদের ছাড় দিবে না।’

রিশিতার মৃত্যু নিয়ে আপাতত একটি ইউডি মামলা হয়েছে বলেও জানান ওসি মজিবুর রহমান।

প্রসঙ্গত, গত শনিবার (২০ জুন) বেলা ১২ টার দিকে কিশোরী রিশিতার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন।

[প্রতিবেদনটি তৈরির কাজে সহায়তা করেছেন আমাদের খোকসা প্রতিনিধি ওবাইদুর আকাশ]
আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড