• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ফেনীর সেই প্রতিবাদী নুসরাত হত্যার এক বছর

  এস এম ইউসুফ আলী, ফেনী

১০ এপ্রিল ২০২০, ০২:৩২
ফেনী
নুসরাত জাহান রাফি

ফেনীর সেই প্রতিবাদী মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার এক বছর আজ। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে সে।

এর আগে ৬ এপ্রিল সকালে নিজ উপজেলার সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম আরবী প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে গেলে হল থেকে ডেকে নিয়ে পাশের ভবনের তৃতীয় তলার ছাদে নিয়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে নিতে রাজি না হওয়ায় তাকে হত্যার জন্য গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়।

১০ এপ্রিল বিকালে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে জেলার সোনাগাজী মো. ছাবের সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নামাজে জানাজা শেষে সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। সেই কবরেই চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন নুসরাত। হত্যার এক বছর উপলক্ষে তার বাড়িতে গেলে দেখা যায় সুনসান নীরবতা। নুসরাতের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তায় তিনজন পুলিশ সদস্য বাড়ি পাহারায় রয়েছেন।

নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার বলেন, আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায় বিচার পেয়েছি। শুনেছি উচ্চ আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আপীল করেছেন। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আসামিদের ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি।

আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, আজ একটি বছর আমি আমার মেয়ের কণ্ঠে মা ডাকটি শুনতে পাইনা। রাতে ঘুম হয়না। কারণ আমার মেয়েকে হাত পা বেঁধে যখন তারা আগুন লাগিয়েছিল, তখন আমার মেয়ে কি করেছিল? সেদিন আমি খবর পেয়ে ফেনী সদর হাসপাতালে ছুটে যাই তখন পুলিশ সদস্যরা আমাকে আমার মেয়ের কাছে ভিড়তে দেয় নাই।

তার পুরো শরীর ব্যান্ডেজ করে ফেলে ডাক্তারেরা পুলিশকে বলে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। বাঁচে কিনা সন্দেহ। তার মা মেয়ের এই শরীর দেখলে স্ট্রোক করতে পারেন। তাকে দূরে রাখেন। তখন আমার মেয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিল। আমার মেয়েকে মহান আল্লাহ তিন দিন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তার জবান থেকে খুনিদের নাম বেরিয়ে আসার জন্য। আমার মেয়েতো সেদিনই মরে যেতো পারতো।

আমার মেয়ে যদি আজকে রোগে মারা যেত তাহলে মনকে বুজ দিতে পারতাম। আমার মেয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় আমাকে অনেক কথা বলেছে। তখন আমার মেয়ে নুসরাতকে আমি বলেছিলাম মামলা তোলার জন্য সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে দিতা। তাহলে তোমার এই অবস্থা হতোনা। তখন আমার মেয়ে আমাকে বলেছিল মা আমি মৃত্যুকে ভয় পাইনা।

তারা সাদা কাগজ ধরে সিগনেচার (স্বাক্ষর) চেয়েছিল তখন আমার মেয়ে রাজি না হওয়ায় তারা হাত-পা বেঁধে কেরোসিন তেল ঢেলে আমার মেয়ের গায়ে দিয়াশালায় মেরে আগুন ধরিয়েছিল। তখন আমার মেয়ে যা চিৎকার দিয়েছিল কেউ শুনতে পায়নি। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় পানি ও ভাত খেতে চেয়েছিল। তখন আমি ডাক্তারদের কাছে অনুমতি চেয়েছিলাম। স্যার আমার মেয়ে পানি ও ভাত খেতে চায়। ডাক্তারেরা আমাকে পানি ও ভাত দিতে নিষেধ করে বলেন, ওরা শ্বাসনালী পুড়ে গেছে।

তাকে পানি ও ভাত খাওয়ানো যাবেনা। আমি একটা বছর যখন ভাত খেতে যাই, তখন আমার মনে চলে আসে আমার মেয়ে ভাত ও পানি বলে বলে খেয়ে যেতে পারে নাই। আমি এখন ভাত না বিষ খাচ্ছি সেটা বুঝতে পারিনা। আজকে বাইরের দেশে করোনাভাইরাসে হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা মনেরে বুঝ দিতে পারবে করোনাভাইরাসে তারা মারা যাচ্ছে। কিন্তু আমার মেয়েকে জানোয়ারেরা হাত-পা বেধে আগুন দিয়ে পুড়ে মেরেছে।

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের ৯৯ভাগ মানুষ আমার মেয়ের পাশে ছিল। আমাদের পরিবারের পাশে ছিল। আসামি ও তাদের স্বজনরাসহ এক পার্সেন্ট মানুষ আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে থাকতে পারে। মাননীয় আইনমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন ১০ এপ্রিল নুসরাত দিবস পালন করা হবে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের জন্য হয়তো সেটি সম্ভব হবেনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমাদের নিরাপত্তার জন্য বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

মহামারি থেকে মানুষকে বাঁচাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক কিছু করছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছেন। তিনি কত যে উদার আমি প্রতিদিন খবর দেখি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্যও অনেক কিছু করেছেন। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়েছেন, যা আমি কখনো ভুলবোনা। খুনিরা ১৬ জন মানুষ এত যে নৃশংস, তাদের মধ্যে একজন মানুষের মনেও বুঝি দয়া হয় নাই।

মামলার বাদী নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান জানান, আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায়বিচার পেয়েছি। উচ্চ আদালতেও আমরা ন্যায়বিচার প্রত্যাশী। আমাদের পরিবারের জন্য খুনিরা ও তাদের স্বজনদের মারাত্মক হুমকি হচ্ছে তাদের ফেসবুক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিষোদগার করে যা ইচ্ছা তাই লিখে যাচ্ছে। আমাদের পরিবারের জন্য খুনি ও তাদের স্বজনদের ব্যবহৃত ফেসবুকই হচ্ছে চরম আতঙ্ক।

২০১৯ সালের ২৭ মার্চ নিজ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার হন রাফি। ওই ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজকে একমাত্র আসামি করে মামলা করেন। একই দিন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ওই মামলা তুলে নিতে অধ্যক্ষের অনুসারী ওই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা রাফি ও তার পরিবারের সদস্যদের চাপ দিতে থাকে।

২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল খুনিরা সিরাজের সঙ্গে কারাগারে পরামর্শ করে এসে ৪ এপ্রিল মাদরাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে খুন করার পরিকল্পনা নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল নুসরাত মাদরাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে খুনিরা পরিকল্পিতভাবে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতকে হত্যার চেষ্টা চালায়। ঘটনাস্থল থেকে নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।

এরপর তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল মামলা দায়ের করেন।

এই মামলায় ২৮ মে অভিযোগ পত্র দাখিলের পর ২০ জুন অভিযোগ গঠন করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। পরে সাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবর নির্ধারণ করেন। মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক গ্রহণ করা হয়।

২৪ অক্টোবর রায়ে ১৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা দণ্ডেও দণ্ডিত করেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ-দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও মাদরাসার সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।

বাদীপক্ষের আইনজীবী এম. শাহজাহান সাজু জানান, ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর আসামিদের মৃত্যু দণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্টে পৌঁছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যু দণ্ডাদেশ হলে তা অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়।সে অনুসারে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপার বুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছিল। পরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়। আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করেছেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি হাসান ইমাম ও সৌমেন্দ্র সরকার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংকটময় পরিস্থিতি কেটে গেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলাটির শুনানি হবে। তিনি আরও বলেন, নুসরাতকে যৌন হয়রানির মামলাটিও স্বাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

ফেনীর নারী লেখক ও সাংবাদিক সাহিদা সাম্য লীনা বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেক নারী নির্যাতিত হয়েছে। সেই ৯৬ এর ইয়াসমিন থেকে শুরু করে এরপর বুশরা, সনি, তনু, রুপাসহ হাজারো নারী। সব হত্যাই আলোড়ন তুলেছিল এই দেশে। অনেক হত্যার বিচার তো দূরে থাক, আসামিরা খালাস ও কোনো কোনটার আসামিরা ধরাও পড়েনি আজও। তবে নুসরাত হত্যাকাণ্ডটি ভিন্ন একটি প্রতিবাদের উদহারণ সৃষ্টি করেছে। এ কারণে দ্রুত সময়ে এ মামলার বিচারও হয়েছে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড