• বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

করোনার প্রভাবে থমকে গেছে যশোরের অর্থনীতি

  যশোর প্রতিনিধি

২৩ মার্চ ২০২০, ১২:০৭
কমার্স
যশোর চেম্বার অব কমার্স (ছবি : দৈনিক অধিকার)

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে যশোর জেলার অর্থনীতি থমকে গেছে। একমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া আর কোন ব্যবসায়ে গতি নেই। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আবাসিক হোটেলগুলো। গ্রাহক শূন্য হওয়ায় বন্ধের পথে এসব হোটেল। কলকারখানাগুলোতে উৎপাদন ধীরে ধীরে কমছে। কমছে বেনাপোল থেকে পণ্য আমদানি।

যশোরের গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এনায়েত ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার সত্ত্বাধিকারী আকতার হোসেন জানান, গত ১৫দিন ধরে তাদের কোন ক্রেতা নেই। অর্ডার না থাকায় যন্ত্রাংশ উৎপাদন করতে পারছেন না। যশোর বিসিকের প্রতিষ্ঠান এমইউসিইএ ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস জানান, আমরা হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করি ১৪টি দেশে।

এর মধ্যে সম্প্রতি জার্মান ও ফ্রান্স থেকে অর্ডার বাতিল করেছে। অন্য দেশগুলোও অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন। যশোরের বড় অর্থনীতির বাজার হলো মোটরপার্টস। শহরের ক্লোডস্টোর এলাকার ফারিয়া মোটরসের মালিক রেজোয়ান আহমেদ মুরাদ জানান, আমি বড় গাড়ির ইঞ্জিন ভারত থেকে আমদানি করে বিক্রি করি। সারা দেশের ক্রেতারা আসেন আমাদের এখানে। আগে প্রতিদিন এক বা দুইটি করে ইঞ্জিন বিক্রি হতো। কিন্তু গত প্রায় এক মাস ধরে কোন ক্রেতা নেই। কর্মচারীদের বেতন ও ব্যাংকের ঋণের কিস্তি চলতি মাসে কিভাবে পরিশোধ করব সেটা নিয়ে চিন্তিত।

যশোর মোটরপার্টস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহিনুর হোসেন ঠান্ডু জানান, দেশের মধ্যে মোটরপার্টসের সবচেয়ে বড় বাজার যশোর। এখানে দেশের বিভিন্ন জেলার গাড়ির মালিকরা আসেন ইঞ্জিন ও খুচরা যন্ত্রাংশ কিনতে। বছরে এখানে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বর্তমানে কোন ক্রেতা নেই। দোকানীরা ব্যাংক ঋণ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

লাইট পিকআপ টিকিং গাড়ির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আল-আমিন এন্টার প্রাইজের পরিচালক আনিছুর রহমান খান বলেন, আমাদের গাড়ি মূলত চীন থেকে আমদানি করে থাকি। গত তিন মাস ধরে গাড়ি আমদানি করতে পারছি না। আবার দেশের বাজারেও গাড়ি বিক্রি থেমে গেছে। এতে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। ব্যাংক ঋণ আমাদের ভাবাচ্ছে।

করোনা ভাইরাস আতঙ্কে যশোরের আবাসিক হোটেলগুলোতে চলছে চরম মন্দাবস্থা। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে হোটেল বন্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ জন গ্রাহক থাকতেন, সেখানে এখন ২ থেকে ৩ জন থাকছেন। আর কয়েকদিন পরে তাও থাকবে না বলে তারা আশংকা করছেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, খুলনা বিভাগের মধ্যস্থল হিসেবে যশোর জেলা পরিচিত। এখানে রয়েছে বিমানবন্দর, দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দর, নওয়াপাড়া নৌ-বন্দর, পাশে মংলা সুমদ্রবন্দর ও ভোমরা স্থলবন্দর। আছে ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা। যশোর থেকে ১৮টি রুটে চলে পরিবহন।

এছাড়া যশোর বিমানবন্দর ব্যবহার করছে খুলনা, মাগুরা, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ী সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। সেই সুবাদে যশোরে পাঁচ তারকামানের আবাসিক হোটেল গড়ে উঠেছে। অথচ শুরুতেই তারা হোঁচট খাচ্ছেন। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে হোটেলগুলো তাদের কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

শহরে বর্তমানে ৫টি আবাসিক হোটেল রয়েছে। হোটেলগুলো হলো জাবের হোটেল ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল ওরিয়ন, হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল সিটিপ্লাজা ও ম্যাগপাই হোটেল।

জাবের হোটেল ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল ম্যানেজার রাকেশ কুমার জানান, খুলনা বিভাগের একমাত্র পাঁচ তারকা হোটেল জাবের। ১৬ তলা বিশিষ্ট হোটেলে ৯৬টি আধুনিক রুম রয়েছে। যার ভাড়া ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৯ হাজার টাকা। এখানে আগতদের জন্য রয়েছে সুইমিংপুল, সকালের নাশতা, বার, রুফটপ, স্প্যা ও বারবিকিউ রেস্টুরেন্ট। রয়েছে সর্বাধুনিক ফায়ার সিকিউরিটি সিস্টেম।

খাবারের মান ভালো হবার কারণে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে হোটেলটি। তবে করোনা ভাইরাসের প্রভাব পড়েছে এখন। যেখানে প্রতিদিন ৪৫-৫০ জন গ্রাহক থাকতেন, সেখানে বর্তমানে থাকছেন পাঁচ থেকে সাত জন। এছাড়া সেমিনার কক্ষ ভাড়া ও রেস্টুরেন্টের ব্যবসাও ভালো ছিল। সেখানেও কোন ব্যবসা নেই। এমন অবস্থা চলতে থাকলে হোটেল বন্ধ করা ছড়া উপায় থাকবে না। কেননা বিদ্যুৎ বিল এবং কর্মীদের বেতনের টাকা উঠবে না।

হোটেল ওরিয়নের স্বত্বাধিকারী ও যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সহসভাপতি সাজ্জাদুর রহমান সুজা জানান, সাড়ে চার বিঘা জমির উপর পাঁচ তারকামানের আবাসিক হোটেল গড়ে তুলা হয়েছে। ১৫ তলা ভবনের হোটেলটিতে রয়েছে ১২১টি রুম। যার মধ্যে ৩০টি ডাবল রুম ও ৩০টি কাপল রুম রয়েছে। এখানে রয়েছে পাঁচটি সভা কক্ষ, তিনটি রেস্টুরেন্ট, সুইমিং, হেলথ ক্লাব, স্প্যা, একশ গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা, ফায়ার স্টেশন ও লন্ড্রি ব্যবস্থা। কিন্তু এখন হোটেল ব্যবসা বন্ধ করা ছাড়া উপায় দেখছি না। কেননা কর্মীদের বেতন চলতি মাসে দিতে পারব কিনা জানি না। যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন গ্রাহক থাকত সেখানে এখন থাকছে মাত্র দুই জন।

একই অবস্থা উৎপাদন শিল্পে। বিসিকে অবস্থিত মদিনা মেটালের স্বত্বাধিকারী ফারুক হোসেন জানান, তাদের উৎপাদিত বাইসাইকেলের রিম সারা দেশে বিক্রি হয়। এখানে শতাধিক মানুষ কর্মরত। অথচ গত এক মাস ধরে চলছে চরম মন্দাভাব। ক্রেতারা মাল নিচ্ছে না। এভাবে চললে কর্মচারীদের বেতন দিতে পারব না।

যশোরের ছিটকাপড় ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হোসেন আলী জানান, গত ২০ বছরেও এমন খারাপ অবস্থা দেখিনি। মানুষ বাজারমুখি হচ্ছে না। গত বিশ দিন ধরে আমরা কাপড় বিক্রি করতে পারেনি।

বেনাপোল বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি দিন দিন কমছে। বেনাপোল আমদানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক জানান, ভারত থেকে পণ্য আমদানি করতে হলে ব্যবসায়ীদের যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু ভিসা স্থগিত করায় কেউ ভারতে যেতে পারছে না। এতে করে পণ্য আমদানি কম হচ্ছে। বেনাপোল বন্দরের পরিচালক আবদুল জলিল বলেন, বন্দর দিয়ে যেখানে প্রতিদিন পণ্য আমদানি হয়ে থাকে সাড়ে ৩শ থেকে ৪শ ট্রাক। সেখানে পণ্য আসছে একশ থেকে দেড়শ ট্রাক।

আরও পড়ুন : যশোরের দুইটি পতিতালয় বন্ধ ঘোষণা

এ ব্যাপারে যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, জেলায় গত ২০ বছরেও তেমন কোন বেসরকারি বিনিয়োগ গড়ে উঠেনি। দুইটি পাঁচতারকা মানের হোটেল নির্মিত হওয়ায় সেই মন্দা অনেকটা কেটেছিল। কেননা এখানে বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও নৌ বন্দর থাকায় শিল্প উদ্যোক্তা ও সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যাতায়াত করেন। তারা হোটেলগুলোতে থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবেন। সেই আলোকে যশোরে ভালোমানের আবাসিক হোটেল গড়ে উঠেছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রভাব সব সেক্টরে পড়েছে। সব ব্যবসায় চলছে মন্দাভাব। হোটেল ব্যবসাও এর বাইরে নেই।

ওডি/এএইচ

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড