• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

অন্ধত্বকে হার মানানো ‘শশীর’ জীবন সংগ্রাম

  হারুন আনসারী, ফরিদপুর

০৯ মার্চ ২০২০, ২২:২৯
শশী
অন্ধত্বকে হার মানানো শশী (ছবি : দৈনিক অধিকার)

জন্মের পর ৩০টি বছর পেরিয়ে গেলেও পৃথিবীর আলো কেমন তা জানেনা ‘শশী’। তবে তিলে তিলে পরিশ্রম করে নিজের ভেতরের আলোকে প্রজ্বলিত করে একজন নারী আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছে সে। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তার জীবনের আলোই আজ নিভতে চলেছে দূরারোগ্য ব্যাধিতে। সময়মতো চিকিৎসা না হলে হয়তো চিরতরে নিভে যাবে তার জীবন প্রদীপ।

ফরিদপুরের মেয়ে শশীর পুরো নাম মারজিয়া রব্বানী শশী। ১৯৯৪ সালের ৩০ মে ফরিদপুরের সদ্য প্রয়াত আইনজীবী গোলাম রব্বানী বাবু মৃধা ও বেগম আফরোজা রব্বানীর ঘর আলো করে দ্বিতীয় মেয়ে হয়ে জন্ম হয় তার। ঐশী জন্মান্ধ। মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর আলো দেখেনি সে। তবে অন্ধকারকে জয় করার ইচ্ছাশক্তি আর অদম্য প্রচেষ্টায় নিজেকেই আলোকিত করে তুলেছে সে। অন্ধ হয়েও সে নিজেকে উচ্চশিক্ষিত করে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একজন আইনজীবী হিসেবে। তার এই অন্ধকার জয়ের কাহিনী যেন রূপকথাকেও হার মানিয়েছে। তার জীবন সংগ্রামের কাহিনী বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে যান তার মা।

আফরোজা রব্বানী দৈনিক অধিকারকে বলেন শশীর বেড়ে ওঠার গল্প। তিনি বলেন, প্রথম যেদিন তাকে ঘরের বাইরে আলোতে বের করেছিলাম তখন থেকে আস্তে আস্তে তার অন্ধত্বের বিষয়টি ধরা পড়ে। কেন জানি মনে হচ্ছিল শশীর চোখে আলো ধরা পড়ে না।

‘মেয়েটিকে রোদে বের করার পর দেখছিলাম সে সূর্যের দিকে চোখ করে চেয়ে আছে। এতটুকু মেয়ের তো সূর্যের আলোর দিকে চেয়ে থাকার কথা না। এরপর তার সামনে হাত বাড়াই। খেলনা ধরি। সে টের পায় না। ধীরে ধীরে বুঝলাম আমার মেয়েটি চোখে দেখে না।’ শশীর মা জানান।

তিনি বলেন, ‘এরপর ভেঙে পড়েছিলাম। ওকে বোধহয় পড়াশোনাও শেখাতে পারব না এমনই আশঙ্কা করেছিলাম। তবে পরে দেখলাম, ওর বোনদের পড়ার সময় পাশে থেকে শুনে শুনেই সে সব মুখস্থ করে ফেলছে। এতে কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠলাম আমি।’

‘সিদ্ধান্ত নিলাম মেয়েকে পড়াশোনা করাব। তারপর আমরাই মুখে মুখে বলে ওকে পড়াতে থাকি। তবে বিষয়টি মোটেও সহজ ছিল না। হাতে ধরে ফ্লোরের ওপর চক দিয়ে লিখে লিখে ওকে অক্ষরের সঙ্গে পরিচিত করাই।’

‘যখন এসএসসির সময় হলো, শশীর ছোট বোন তাবিদা ওর হয়ে পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখে দেওয়ার অনুমতি পায়। প্রশ্ন পড়ে শোনানোর পর শশী মুখে মুখে উত্তর দিত। আর তাবিদা সেটি খাতায় লিখে দিত। এভাবে সে এসএসসিতে প্রথম বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়।’

ফরিদপুরের সরকারি সারদা সুন্দরী কলেজ থেকে এইসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সে ভর্তি হয় ঢাকার সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে সে আইনে অনার্স সম্পন্ন করে।

শশীর মা জানান, ‘বাড়ির বাইরে ঢাকায় যাওয়ার পর তার পড়াশোনা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তখন আমি টেলিফোনে তাকে পড়া বলে দিতাম। সে সেটি শুনে শুনে মুখস্থ করত। এরপর প্রতি সপ্তাহে ঢাকায় গিয়ে আমি তার পড়া টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করে দিয়ে আসতাম। সে সেসব শুনে শুনে মুখস্থ করত।’

এভাবে ২০১৫ সালে শশী আইনে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১৮ সালে তিনি বার কাউন্সিলের সনদ পেয়ে ফরিদপুর জেলা আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এভাবে অন্ধত্বকে জয় করে নতুন এক ইতিহাসের সৃষ্টি করেন তিনি।

২০১৫ সালে পরিববারের সম্মতিতে তিনি মধুখালী উপজেলার মেগচামী ইউনিয়নের মো. জাহাঙ্গির আলমকে বিয়ে করেন। অন্ধত্বকে এভাবে জয় করে তাক লাগিয়ে দিলেও জীবন যেন তার কাছে এখনো কঠিন হয়েই রয়েছে। ইতোমধ্যে ধরা পড়েছে শশীর কিডনি বিকল হতে চলেছে। নিয়মিত কিডনি ডায়ালাইসিস করে তাকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।

এই প্রতিবেদন লেখার সময় শশী ঢাকার শ্যামলীতে একটি কিডনি হসপিটালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও শশীর চিকিৎসক ডা. স্বপন কুমার মন্ডল জানিয়েছেন, শশীর কিডনি প্রতিস্থাপন করতে না পারলে ও হয়তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না।

আরও পড়ুন : সুবিধাবঞ্চিত নারীদের ভরসা কল্যাণী হাসান

ফরিদপুরের প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ শশীর এই দুরবস্থায় অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে বলেন, ফরিদপুর বারের একজন সম্ভাবনাময়ী নারী আইনজীবী শশী। ওর মতো অন্ধ হয়ে এর আগে কেউ এখানে আইন পেশায় আসেনি। আমরা ওর দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। আশা করছি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ও আবার সুস্থ হয়ে উঠবে।

শশীর পারিবারিক সূত্র জানায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শশীর কথা জেনে তার চিকিৎসার জন্য দুই লাখ টাকা দেন। এছাড়া সম্প্রতি অন্ধত্বকে জয় করে এভাবে আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শশীকে একটি বেসরকারি সংস্থা অ্যাওয়ার্ড ও নগদ আর্থিক সহায়তা দেয়। তবে শশীর চিকিৎসার জন্য ইতোমধ্যে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। তাকে বাঁচিয়ে তুলতে আরও অনেক টাকা দরকার। অন্ধত্বকে জয় করা শশী কি পারবে মানবিক হৃদয়গুলোকে জয় করে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে?

ওডি/এএসএল

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড