সাভার প্রতিনিধি, ঢাকা
সাভারের আশুলিয়ায় একটি গার্মেন্টস কারখানার অপরিশোধিত শিল্প বর্জ্য সরাসরি আবাদি জমিতে গিয়ে পড়ছে। এ বর্জ্য ফেলায় বোরো মৌসুমে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন এখানকার কয়েকশ কৃষক। কেমিক্যাল মিশ্রিত এসব বিষাক্ত পানি সরাসরি জমিতে এসে পড়ার কারণে কৃষি মাটির উর্বরতা হারিয়ে নষ্ট হচ্ছে ফসল উৎপাদন ক্ষমতা।
শুধু ফসলই নয় মারাত্মক এ দূষণের কবলে খালের মাছসহ মারা যাচ্ছে বিভিন্ন জলজ প্রাণী। ফলে হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ। স্থানীয় কৃষক ও এলাকাবাসী এর প্রতিকার চাইলেও উপজেলা কৃষি বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় টনক নড়েনি এই কারখানা কর্তৃপক্ষের।
নিয়ম অনুযায়ী কারখানার বর্জ্য ইফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের (ইটিপি) মাধ্যমে পরিশোধন করার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি সেসব নিয়মের তোয়াক্কা না করেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
আশুলিয়ার শিমুলিয়া ইউনিয়নের মেশিনপাড় এলাকায় নায়াগ্রা গ্রুপের জিটিএ স্পোর্টস লিমিটেড নামের একটি ডায়িং কারখানার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেছেন স্থানীয় কৃষক ও এলাকাবাসী।
এলাকাবাসী জানায়, ওই পানিতে নামলেই তারা বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। পাশাপাশি গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি মারা যাচ্ছে। কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি খালের মাধ্যমে আবাদি জমিতে গিয়ে পড়ার কারণে প্রতিবছর ছাদিরপুর গ্রামের অন্তত ৩০ একর জমির ধানসহ বিভিন্ন রবি শস্য নষ্ট হচ্ছে। অব্যাহত লোকসান ও ফসল ঘরে তুলতে না পারায় অনেক কৃষক বিভিন্ন কারখানা মালিকের কাছে জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। গ্রামের অনেক বাসিন্দা গবাদি পশু পালনও ছেড়ে দিয়েছেন। এছাড়া কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য ও পানির কারণে খাল পাড়ের গাছপালাও মারা যাচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
কৃষক ফজল হক বলেন, ‘এ বছর বোরো মৌসুমে চার বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি। কিন্তু ওই কারখানার ডায়িংয়ের ময়লাযুক্ত পানি সরাসরি ক্ষেতে প্রবেশ করায় আমাদের ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জমিতে কেমিক্যাল বর্জ্যে অধিক পরিমাণ কাদা জমে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুরুতে ধানের গোছা মোটা ও সবুজ দেখালেও বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে সামান্য বৃষ্টিতেই ধান ঝরে যায়। পাশাপাশি ক্ষেতে প্রচুর পরিমাণে পোকামাকড়ের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছি আমরা।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘উপজেলা কৃষি অফিস ও বাজার থেকে কেনা কীটনাশক প্রয়োগ করেও কোনো ফল মিলছে না। এছাড়াও দুর্গন্ধযুক্ত কাদামাটির আধিক্যের কারণে গবাদি পশু দিয়ে ক্ষেতে হাল চাষসহ স্বাভাবিক কাজ করা তাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ, উপজেলা কৃষি অফিস ও প্রভাবশালীদের কাছে আমরা অনেকবার বলেও কোনো প্রতিকার পাইনি।
কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, ‘জিটিএ কারখানা কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি ছেড়ে দেওয়ায় আমাদের শত শত বিঘা কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। গত ৮-১০ বছর পূর্বেও বোরো মৌসুমে আমরা বিঘা প্রতি ৩০-৪০ মণ ধান পেতাম। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বিঘা প্রতি মাত্র ৭-৮ মণ ধান পাচ্ছি। এমন লোকসানের কারণে অনেকেই চাষ বাদ দিয়ে দিনমজুরের কাজ করছেন। কিন্তু অনেকে বাধ্য হয়ে ক্ষতির মুখেই চাষাবাদ করছেন। এ বিষয়ে কারখানার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
স্থানীয় চিকিৎসক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম জানান, বর্জ্য মিশ্রিত ওই পানিতে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও ক্রোলিনসহ নানা ক্ষতিকারক উপাদান থাকে। ওই পানি যখন হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পান করে তখন চর্মরোগ ও চামড়া প্রদাহসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। এমনকি মারাও যায়।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কারখানার এইচআর ম্যানেজার মতিউর রহমান বলেন, কারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য ইটিপির মাধ্যমে শোধন করেই নির্গত করা হচ্ছে।
যদিও কারখানার পেছনের অংশে বিরাট একটি পুকুরে জমিয়ে রাখা দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানির ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
কারখানার পেছনে পুকুরে জমিয়ে রাখা দুর্গন্ধযুক্ত পানি (ছবি : দৈনিক অধিকার)
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শফি মোহাম্মদ তারেক বলেন, কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফসলি জমি থেকে খাদ্য চক্রের বিষক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করে। তাই সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য ইটিপিতে শোধনের পরই যাতে শিল্প কারখানাগুলো তা পরিবেশে ছাড়ে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরকে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। যেসব কারখানা তা অমান্য করে পরিবেশ দূষণ করবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এ দিকে সাভার উপজেলা কৃষি অফিসার নাজিয়াত আহমেদ শিমুলিয়ার ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে থেকে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
গার্মেন্টস কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিধি অনুযায়ী এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আশুলিয়া সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ।
ওডি/এমবি
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড