• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

জিভে জল আসা মুক্তাগাছার মন্ডা

  ময়মনসিংহ প্রতিনিধি

০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২২:১৭
মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী মন্ডা
মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী মন্ডা (ছবি : দৈনিক অধিকার)

মানুষ মাত্রই রসনাবিলাসে আসক্ত। মুক্তাগাছার মন্ডার নাম শোনেননি এমন লোক পাওয়া যায় না। এ মন্ডার খ্যাতি আর স্বাদের কথা শুনলে যে কারো জিভে জল এসে যায়। ২শ বছর ধরে মাথা উঁচু করে আপন অবস্থানে থেকে স্বাদে গুণেমানে সমৃদ্ধ এ মন্ডা আজও কদর ধরে রেখেছে। বিয়ে, জন্মদিন, আকিকা, অতিথি আপ্যায়নসহ যে কোনো ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে মুক্তাগাছার মন্ডা ছাড়া পূর্ণতা ভাবাই যায় না।

মুক্তাগাছার মন্ডার আবিষ্কারক গোপাল পালের এ মন্ডা দেশের সীমানা পেরিয়ে ভোজন রসিকদের হাত ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে নিজের অবস্থানের শীর্ষে ধরে রেখেছে। কিংবদন্তি এ মন্ডার সঙ্গে বর্তমানে জড়িয়ে আছে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার ইতিহাস। মুক্তাগাছার ইতিহাসের সঙ্গে এ মন্ডা যুক্ত হয়ে এ এলাকাকে করেছে আরও সমৃদ্ধ।

মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী মন্ডা আসলে এক প্রকার সন্দেশ। দুধের ছানা ও চিনি দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। মন্ডা যারা তৈরি করেন কেবল সেই কারিগররাই জানেন। ২শ বছর আগে মন্ডার স্বাপ্নিক রাম গোপাল পাল ওরফে গোপাল পাল এ মন্ডা প্রস্তুত করেন জমিদার পরিবারকে তুষ্ট করার জন্য। সেই সময়ের মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে মন্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। মহারাজা এ মিষ্টান্ন খেয়ে এর ভূয়সী প্রশংসা করেন।

ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে মুক্তাগাছা পৌরসভা শহরে জমিদার বাড়ির কাছেই পূর্ব দিকে রাম গোপাল পাল ওরফে গোপাল চন্দ্র পালের মন্ডার দোকান। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে রাম গোপাল চন্দ্র পাল ওরফে গোপাল পাল মন্ডা তৈরি করেছিলেন। সেই সময়ের জমিদারদের খুবই পছন্দের মিষ্টান্ন ছিল এ মন্ডা। তাদের হাত ধরে ক্রমশ উপমহাদেশের সবখানে ছড়িয়ে পড়ে এ মন্ডার খ্যাতি। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ মুক্তাগাছার মন্ডা খেয়েছেন।

এ মন্ডা খেয়ে তৎকালীন রাজা-জমিদাররা নানাভাবে গোপাল পালকে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত করেছেন। গোপাল পালের দোকানের বর্তমান মালিক পঞ্চম বংশধর রমেন্দ্র পাল মৃত্যুবরণ করায় ছোটভাই শ্রী রবীন্দ্র নাথ পাল এর তত্বাবধান করেন।

তিনি জানান, মন্ডা তৈরির পেছনে রয়েছে অলৌকিক ঘটনা। মন্ডার স্বাপ্নিক গোপাল পাল খুবই ঈশ্বর ভক্ত ছিলেন। পরপর কয়েক রাতে স্বপ্নে এক সন্ন্যাসী তাকে মন্ডা তৈরির পদ্ধতি শেখান। সেই সন্ন্যাসী তাকে বলেন, ‘কাল থেকে তুই (গোপাল পাল) মন্ডা বানানো শুরু কর।’

পরে ওই সন্ন্যাসীর নির্দেশে মন্ডা তৈরি শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে দেখলেন স্বপ্নে দেখা সেই সন্ন্যাসী সশরীরে উপস্থিত হয়ে মন্ডা তৈরির উনুনে হাত বুলাচ্ছেন। তখন সন্ন্যাসীকে ভক্তি করায় সঙ্গে সঙ্গে গোপালের মাথায় হাত রেখে বলেন, তোর হাতের মন্ডা মিঠাই একদিন জগত বিখ্যাত হবে। এ আশীর্বাদ করে সন্ন্যাসী অদৃশ্য হয়ে যায়।’

মুক্তাগাছার মন্ডার বিষয়ে বর্তমান দোকান তত্বাবধানকারী শ্রী রবীন্দ্র নাথ পাল একটি পুস্তিকা হাতে দিয়ে দৈনিক অধিকারকে বলেন, এতে বিস্তারিত লেখা রয়েছে। প্রতিনিয়তই মানুষ জানতে চায় এ মন্ডার ইতিহাস। এ অবস্থায় সময় দেওয়া সম্ভব হয় না, বাধ্য হয়েই কোনো মিডিয়াকে আর সাক্ষাৎকার দেওয়া হয় না।’

পুস্তিকা ঘেঁটে জানা গেছে, মুক্তাগাছার মন্ডার স্বাপ্নিক গোপাল চন্দ্র পাল ১৭৯৯ সালে জন্ম গ্রহণ করে দীর্ঘ ১০৮ বছর ইহলোকে থেকে মারা গেছেন ১৯০৭ সালে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর পালিয়ে গোপাল পালের বাবা রামরাম পাল তার বাবা শিবরাম পাল মুর্শিদাবাদ ছেড়ে মালদহ হয়ে রাজশাহী আসেন। এরপর চলে আসেন মুক্তাগাছার তারাটি গ্রামে। গোপাল পালের মৃত্যুর পর তার ছেলে রাধানাথ পাল, রাধানাথের ছেলে কেদার নাথ পাল, কেদার নাথের ছেলে দ্বারিকনাথ পাল এবং দ্বারিকনাথের ছেলে রমেন্দ্র নাথ পাল এন্ড ব্রাদার্স মন্ডা তৈরি করে বিক্রি করছেন। রমেন্দ্র নাথ পাল মৃত্যুবরণ করায় তার ছোট ভাই হিসেবে শ্রী রবীন্দ্র নাথ পাল এন্ড ব্রাদার্স মন্ডার দোকানের তত্বাবধানে রয়েছেন।

এতে আরও জানা গেছে, মুক্তাগাছার জমিদার জীবেন্দ্র কিশোর আচার্য চৌধুরী রচিত ‘আমি’ বইটিতে মন্ডার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি কেদারনাথ পালকে প্রশংসা পত্রও দিয়েছিলেন। চির ঐতিহ্যের ধারক মুক্তাগাছার মন্ডার স্বাদ নিয়েছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সেতার বাদক ও সুর সম্রাট ওস্তাদ আলা উদ্দিন খাঁ, বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় (পরে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী), নেতাজী সুবাষ চন্দ্র বসু।

মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত মহারাজপুত্র শশিকান্ত আচার্য চৌধুরীরও প্রিয় মিষ্টান্ন ছিল এ মন্ডা। মহারাজ রাশিয়ার নেতা স্টালিনের কাছে এ মন্ডা পাঠিয়েছিলেন। স্টালিন মন্ডা খেয়ে মহারাজার কাছে প্রশংসাপত্র পাঠান। পাকিস্তান আমলে মন্ডা ভক্ত মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী একবার মন্ডা নিয়ে চীনে গিয়েছিলেন। আপ্যায়িত করেছিলেন চীনের নেতা মাও সেতুংকে।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর থাকাকালীন মন্ডা খেয়ে প্রশংসা করেন।

পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তাগাছার এক সভায় এসে মন্ডা খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন। সে সময়ে মন্ডার দোকানের মালিক কেদার নাথ পালকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পাল মশাই দেশ ছেড়ে যাবেন না, দেশ ভালো হবে।’

স্বাধীনতার পর তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে এলে মুক্তাগাছার মন্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল তাকে বঙ্গবন্ধু। ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ একবার ঢাকায় এসেছিলেন। তাকে মন্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। তিনিও মন্ডা মিষ্টির প্রশংসা করেছিলেন।

ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার শ্রীমতি বীনা সিকরী ২০০৬ সালের ৯ এপ্রিল মুক্তাগাছা এসে দোকান পরিদর্শন করেন। এ সময় মন্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করা হলে তিনি মিষ্টির ভূয়সী প্রশংসা করে পরিদর্শন বইয়ে মন্তব্য লেখেন।

এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর হুয়াদু ২০০৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মন্ডার দোকান পরিদর্শনে এসে মন্ডা খেয়ে পরিতৃপ্তি লাভ করেন। পরে দোকানের পরিদর্শন বইয়ে মন্তব্য লেখেন।

নবম জাতীয় সংসদের তৎকালীন মাননীয় স্পীকার ও বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ ২০০৯ সালের ১৭ জুন সংসদে মজা করে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ খালিদ বাবুকে মুক্তাগাছার মন্ডা খাওয়ানোর কথা বললে পরদিন তিনি ৭২০টি মন্ডা নিয়ে হাজির হন। পরে মাগরিবের নামাজের বিরতির আগে মাননীয় স্পীকার অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘মাননীয় সংসদ সদস্যগণ, মুক্তাগাছার মন্ডা এসে গেছে, সরকারি ও বিরোধী দলের লবিতে দেওয়া আছে। তবে দুটির বেশি কেউ খাবেন না।’

দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিল্পী ও সাহিত্যিকসহ বিভিন্ন শেণি-পেশার মানুষজন মুক্তাগাছা এলে মন্ডা না খেয়ে যান না। সকলেই এ রসনাবিলাসের প্রশংসা করেন।

আরও পড়ুন : ব্রিজ নয়, যেন মরণ ফাঁদ

মুক্তাগাছা ছাড়া দেশের আর কোথাও এ প্রতিষ্ঠানের শোরুম নেই। প্রতি কেজি মন্ডা সাদা ৫০০ টাকা এবং গুড়ের মন্ডা ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। তবে মুক্তাগাছায় বর্তমানে অনেকেই এই মন্ডা তৈরি করছেন।

মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী রসনাবিলাস মন্ডার প্রতিষ্ঠাতা গোপাল পাল না ফেরার দেশে চলে গেলেও রেখে গেছেন তার কীর্তি। তাই মুক্তাগাছার মন্ডার নাম শুনলে স্বাদ নিতে সকলের জিভে পানি এসে যায়। আর মনে পড়ে মন্ডার স্বাপ্নিক গোপাল পালের নাম।’

ওডি/এএসএল

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড