শাহারিয়ার রহমান রকি, ঝিনাইদহ
ঝিনাইদহের প্রত্যন্ত অঞ্চল আসাননগর গ্রামের কৃষক হরিপদ কাপালীর অমর কীর্তি ‘হরি ধান’। বর্তমানে ব্যাপক হারে এ ধানের চাষাবাদ না হলেও ভাত খেতে সুস্বাদু এই ধানটি এখনো চাষাবাদ করছেন। কিছুটা হলেও অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এই জাতের ধানটি।
জানা যায়, ২০০২ সালের দিকে আষাঢ় মাসে ইরি ধানের ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে দেখেন তিন-চারটি ধানের গাছ। যা অন্যগুলোর থেকে মোটা ও আকারে বড়। যেহেতু এগুলো আকারে বড় সুতরাং ভালো ফলন হতে পারে এমন আশায় সেগুলো রেখে দেন। পরবর্তীকালে এর বীজ থেকে চারা তৈরি করে চার হাত বাই চার হাত জায়গায় পরীক্ষামূলক চাষ করেন।
সেখানেও ফলন ভালো হয়। এরপর থেকে এ ধানের চাষ বাড়াতে থাকেন হরিপদ কাপালী। পরে স্থানীয়ভাবে ও আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে বিস্তার লাভ করে এই ধান। জাতটির কারও নাম জানা না থাকায় এটি আস্তে আস্তে পরিচিতি লাভ করে হরি ধান হিসেবে।
বর্ষা মৌসুমে চাষকৃত মোটা জাতের এই ধানের বিঘা প্রতি ফলন হয় গড়ে ১৫ থেকে ১৬ মন হারে। কিন্তু উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম এবং ভাত খেতে অনেক সুস্বাদু হওয়ায় একসময় ধানটি স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর থেকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ধানটি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আর মেলেনি ধানের স্বীকৃতি। কমতে থাকে এই ধানের চাষাবাদ।
স্থানীয় আসাননগর গ্রামের কৃষক নজির আহমেদ বলেন, ‘আগে সাড়ে তিন বিঘা জমিতে এই ধান চাষ করতাম। কিন্তু গেল মৌসুমে ১৫ কাঠা জমিতে লাগিয়েছিলাম শুধু খাওয়ার জন্য। এখন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান হওয়ায় এই হরি ধান চাষ কমিয়ে দিয়েছি। আমার মতো অনেক চাষিই এখন আর হরি ধান চাষ করে না।’
এলাকার অন্য চাষি আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এটি মোটা জাতের ধান। এখন অল্প কিছু জমিতে শুধু খাওয়ার জন্য বর্ষা মৌসুমে এই ধান চাষ করি। হরি ধানে উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় এ ধান চাষে লোকসান হয় না।’
নিঃসন্তান হরিপদ কাপালীর স্ত্রী সুনীতি রানী কাপালী এবং পালিত পুত্র রুপ কুমার ও পুত্রবধূ সুষমা কাপালীকে নিয়ে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। পরে ২০১৬ সালের ৬ জুন পরলোকগমন করেন হরিপদ কাপালী।
সরেজমিনে সদর উপজেলার আসাননগর গ্রামে প্রয়াত হরিপদ কাপালীর বাড়িতে গিয়ে স্ত্রী সন্তানকে পাওয়া না গেলও কথা হয় পুত্রবধূ সুষমা কাপালীর সঙ্গে।
তিনি দৈনিক অধিকারকে বলেন, ‘এখন হরি ধান চাষ কিছুটা কমে গেছে। বর্তমানে নিজের জন্য এবং কয়েকজনের অর্ডারের প্রেক্ষিতে তিন মন ধান বীজ রেখেছি। আমার শ্বশুর মারা যাওয়ার পর শুনেছি এই ধান নাকি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে। সরকারের কাছে দাবি যেন ব্যাপকভাবে হরি ধান চাষ করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা কৃষি বিভাগের কাছে নেই হরি ধানের স্বীকৃতির কোনো প্রমাণপত্র, প্রয়াত হরিপদ কাপালীর পরিবারের কাছেও নেই তথ্য প্রমাণ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন স্থানীয় সাধুহাটি ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিলন কুমার ঘোষ জানান, আমাদের কাছে স্বীকৃতির কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। অনেকদিন আগে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক গবেষণার জন্য আমার কাছ থেকে হরি ধান নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সে আর কোনো ফলাফল জানায়নি।
বিষয়টি নিয়ে মোবাইলে কথা হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পরিচালক (গবেষণা চলতি দায়িত্ব) ড. তমাল লতা আদিত্য দৈনিক অধিকারকে জানান, হরি ধান ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছাসহ বিভিন্ন এলাকায় চাষাবাদ হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক তোড়-জোড় দেখে বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে আমি নিজেও গিয়েছিলাম ঝিনাইদহের আসাননগর গ্রামে।
আরও পড়ুন : ‘এখন আর পোড়ানো ইট ব্যবহারের প্রয়োজন নেই’
তিনি বলেন, পরবর্তীকালে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে দেখি এর মধ্যে বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। ধানও মোটা আকৃতির, ফলনও অনেক কম। যেহেতু বর্তমানে অনেক উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান আবিষ্কার হয়েছে, ফলে স্থানীয়ভাবে পরিচিত হরি ধানকে আর স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। যেহেতু এলাকার কিছু মানুষ চাষ করে তাই আর স্বীকৃতি না দিলেও চাষাবাদ করতে নিষেধ করা হয়নি।
ওডি/এফইউ
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড