• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ঐতিহাসিক ছুরুত বিবির মসজিদ ও আলাওলের বংশধরদের কবর

  জাহাঙ্গীর আলম, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম

১৫ জানুয়ারি ২০২০, ১৩:৫৫
ঐতিহাসিক ছুরুত বিবির মসজিদ
ঐতিহাসিক ছুরুত বিবির মসজিদ (ছবি : দৈনিক অধিকার)

চট্টগ্রামের আনোয়ারা বারখাইনের শোলকাটা গ্রামে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ছুরুত বিবির মসজিদ। অষ্টদশ শতকের গোড়ার দিকে নির্মিত এই মসজিদকে ঘিরে এলাকায় নানা ধরনের জনশ্রুতি রয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ ও পশ্চিমে রয়েছে বিশাল দুটি দিঘি। দক্ষিণের দীঘিটি ছুরুত বিবি দিঘি আর পশ্চিমের দীঘিটি আমীর খাঁ দিঘি নামে পরিচিত। আর আমীর খাঁ দীঘির দক্ষিণে শেখ রাজার বসতভিটা রয়েছে।

আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ১৫৭৫ সালে দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে গৌড় রাজ্য ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। ওই সময়ে গৌড় রাজ্যের সেনাপতি শেখ মোহাম্মদ আদম গৌড়ী রাজ্য ত্যাগ করে দেয়াঙ রাজ্যের অন্তর্গত শোলকাটা গ্রামে স্বপরিবারে বসতি স্থাপন করেন। এ বংশের একজন জমিদার ছিলেন শেখ আমির মুহাম্মদ চৌধুরী।

ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিনের ‘দেয়াঙ পরগনার ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আরাকান রাজসভার মহাকবি আলাওলের দ্বিতীয় কন্যা ছুরুত বিবির বিয়ে হয় দেয়াঙ পরগণার মুঘল অংশের দেওয়ান পরিবারের এক জমিদার বাড়ির ছেলে দেওয়ান আমির মোহাম্মদ চৌধুরীর সঙ্গে। বিয়ের পর আমীর মুহাম্মদ চৌধুরী স্ত্রীর নামেই এ ছুরুত বিবি মসজিদ নির্মাণ করেন। ধারণা করা হচ্ছে, মোগল শাসনামলে (১৭১৩-১৭১৮) এ মসজিদ নির্মিত হয়।

জানা যায়, দেওয়ান পরিবার খুবই প্রজাবৎসল শাসক ছিল তাই এদের সুনাম ছিল দেশব্যাপী। এমনকি দেশ ছাড়িয়ে দিল্লীর মসনদ পর্যন্ত তাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাচীনতম এ মসজিদটি ঘিরে নানা কথা প্রচারিত রয়েছে। এ মসজিদে এক সময় নামাজ পড়তে যেত না মানুষ। লোকজনের ধারণা ছিল, জিনেরা এ মসজিদে নামাজ পড়ত।

বর্তমান মসজিদ কমিটির সদস্য মো.নাজিম উদ্দিন জানান, সাম্প্রতিককালে ১৯৬০ সালে সর্ব প্রথম এ মসজিদে নামাজ পড়েন আনোয়ারা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক মৌলানা ইদ্রীস আহমদ। এর আগে পুরাতন একটি পাকা মসজিদ থাকলেও কোনো লোক নামাজ পড়তে আসত না।

মসজিদের মোতাওয়াল্লি ও কমিটির সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কাশেম বলেন, আমার পূর্ব পুরুষেরা ধারাবাহিকভাবে বংশে একজন করে এ মসজিদের মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দলিলপত্রাদি সূত্রে বংশ পরম্পরায় আমি পঞ্চম মোতাওয়াল্লি। ১৯৮৮ সালে আমার বাবা নুরুল আলম মারা যাওয়ার পর আমি এ দায়িত্ব পায়।

তিনি আরও জানান, এক সময় এ মসজিদে শুধু জোহর আর আসরের নামাজই পড়ত লোকজন। জনশ্রতি ছিল এখানে জিনেরা নামাজ পড়ত, তাই সন্ধ্যা হলে এখানে ভয়ে কোনো মানুষ আসত না। ১৯৯০ সালের পর থেকে এখানে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছেন স্থানীয়রা।

এ দিকে, ছুরুত বিবির মসজিদের দক্ষিণ পাশেই রয়েছে সারি সারি ১২টি কবর।

মহাকবি আলাওলের বংশধরদের কবর (ছবি: দৈনিক অধিকার)

ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ছুরত বিবির বিয়ের বছর দেড়েক পর ঘর আলো করে আসে দুই ছেলে জাফর খাঁ আর মুজাফফর খাঁ। ছেলেরা একটু বড় হতেই মুঘল সম্রাট তাদের ডেকে নেন দিল্লীতে। হাজার লোক দিল্লীর রাজপথে দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়ে নিয়ে যায় এদের রাজপ্রাসাদে। মুঘলদের পক্ষ থেকে তাদের নবাবী সনদ দেওয়া হয়।

আনোয়ারার আরেকজন প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন জবরদস্ত খাঁ ওরফে মনু মিয়া। তিনি ছুরুত বিবির দুই সন্তানের নবাবী সনদ পাওয়াকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। তিনি ছুরুত বিবির দুই সন্তানের জমিদারি পরিচালনায় প্রকাশ্যে ও গোপনে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকেন। নবীন দুই জমিদারের পক্ষে মনু মিয়ার এসব অন্যায় অপকর্মের প্রতিবাদ করার মতো সাধ্য ছিল না। কারণ সে সময় মনু মিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন চট্টগ্রামের প্রভাবশালী আরেক জমিদার নবাব ইয়াছিন খান।

কথিত আছে, নবাব ইয়াছিন খানের সহযোগিতায় মনু মিয়া ছুরুত বিবির দুই সন্তান জাফর খাঁ ও মোজাফফর খাঁকে ধরে নিয়ে যান। এরপর তারা আর কোনোদিন ফিরে আসেননি। ঘটনার বেশ কিছুদিন পর দুই ভাইয়ের খণ্ডিত মস্তক চট্টগ্রাম নগরীর কাটা পাহাড় নামক পাহাড় থেকে উদ্ধার করা হয়।

পরবর্তী সময়ে দুই ভাইকে নির্মমভাবে হত্যার প্রতিবাদে দেওয়ান পরিবার আক্রোশে ফেটে পড়ে। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে হিংস্র ও অত্যাচারী জমিদার মনু মিয়া দেওয়ান পরিবারের আরও ১৬ সদস্যকে তরবারি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে হত্যা করেন।

আরও পড়ুন: ঝিনাইদহে বিএসএফের ধাওয়ায় নদীতে ডুবে যুবকের মৃত্যু

ঐতিহ্যবাহী ছুরুত বিবির মসজিদের দক্ষিণ পাশে সারি সারি এই কবরগুলো ছুরুত বিবি পরিবারের সদস্যদের, যাদেরকে মনু মিয়া হত্যা করেছিল। এই ষোল হত্যাকাণ্ড থেকে আজকের এই শোলকাটা গ্রামের নামের উৎপত্তি।

ওডি/ এফইউ

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড