রফিকুল ইসলাম রফিক, গাইবান্ধা প্রতিনিধি
‘ভোরে ঘুম থেকে ওঠার আগেই হইচই। ঘরের দরজা খুলতেই বন্দুক হাতে হুরমুর করে ঢুকল কয়েকজন। কী যেন কী বলছিল তারা। কিছু বুঝতে না পেরে ছোট দুই মেয়েকে বুকে চেপে মাচার নিচে ঢুকে যাই। লুকিয়ে থাকায় আমি আর আমার দুই সন্তান বাঁচলেও স্বামী, ভাতিজা আর চাচা শ্বশুরসহ আটজন প্রাণ হারান। মাচা থেকে বেরিয়ে ছলছল চোখে তাকাতেই দেখি ঘরে রক্তের বান বয়ে যাচ্ছে। মাটিতে পড়ে ছিল আটজনের লাশ।’ কথাগুলো বলতে বলতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন একাত্তরে স্বজনহারা রেজিয়া বেগম।
মুক্তিযুদ্ধে স্বামী হারানোর বেদনা বুকে চেপে সন্তান নিয়ে বেঁচে আছেন গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালী গ্রামের রেজিয়া বেগম। দেশ স্বাধীনের ৪৮ বছর কেটে গেলেও মুক্তিযুদ্ধে স্বজনহারা রেজিয়ার কপালে জুটেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। মুক্তিযুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেড় বান টিন আর ২ হাজার টাকা দেন। এর পরে স্বামী-স্বজনহারা বিধবা রেজিয়ায় আর তাদের স্বজনদের খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি কেউ।
রেজিয়া বলেন, ‘শুধু মানুষ মেরে ক্ষান্ত হয়নি পাকিস্তানি হানাদাররা। যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যায় গোয়ালে থাকা গরুগুলো। মিলিটারিদের গুলির ভয়ে মৃত স্বজনদের দাফন দিতে এগিয়ে আসেনি এলাকাবাসীরা। ছোট ছেলে আর ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই কবর খুড়ি। রক্তাক্ত লাশগুলোর কেউ মাথা কেউবা পা ধরে এক কবরে দুইজন করে মাটি চাপা দেয়। অল্প বয়সে বিধবা হলাম, কী দোষে স্বামীকে হারালাম তা জানা নেই। তখন থেকে অন্যের বাড়িতে কাজ করে খাই। জীবনে আর সুখ হলো না আমার।’
রেজিয়া বেগম আক্ষেপ করে বলেন, বৃদ্ধ বয়সে মানুষের বাড়িতে কাজ না করলে ভাত জোটে না। থাকার আশ্রয়টুকুও নেই। একটা ঘরের জন্য চেয়ারম্যান-মেম্বার বলেও ঘর পাইনি। তার অভিযোগ, যারা টাকা দেয় তারা ঘর পায়। আমার কাছে টাকা নেই তাই ঘরও নেই।
রেজিয়া আরও বলেন, ‘একটু বৃষ্টি হলেই অন্যের ঘরে থাকতে হয়। শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার কারণে সেদিন স্বামী, দেবর-ভাসুর, ভাতিজাসহ পরিবারের আটজনকে পাখির মতো গুলি করে মারে পাক সৈন্যরা। সেই স্মৃতি মনে হলে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না। কতজন আসলো নাম লিখে নিয়ে গেল কিছুই পাইনি। এখন অসুস্থ শরীর নিয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় এখন মৃত্যুর প্রহর গুণছি।’ গাইবান্ধা জেলায় শুধু রেজিয়া নন মুক্তিযুদ্ধে স্বজনহারা অন্যদেরও একই অবস্থা বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে উদাখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মুঠোফোনে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় একই পরিবারের আটজনকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী এ ঘটনা আমি শুনেছি। তবে রেজিয়া বেগমের থাকার ঘর নেই এ খবর আমি জানি না। এর আগে তিনি আমার কাছে আসেননি।
মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা আর স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য স্বজনহারাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির নেতারা।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন বলেন, বিষয়টি আমি জানি না, আপনার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে থাকে তবে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ দিকে, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই বিজয়স্তম্ভ, তাদের উত্তরসূরীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
ওডি/এসজেএ
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড