• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

যে গ্রামের দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে আলপনার ছোঁয়া

  মো. তারেক রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

১৬ নভেম্বর ২০১৯, ২৩:০৩
আলপনা
দেয়ালে দেয়ালে এভাবেই শোভা পায় নারীদের তৈরি এসব আলপনা (ছবি : দৈনিক অধিকার)

আবহমানকাল ধরে বাঙালির উৎসবকে রাঙিয়ে তুলেছে বিভিন্ন কারুকার্যময় আলপনা। আর স্মরণাতীতকাল থেকেই বাংলার নারীরা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আলপনার এ অনুশীলন করে আসছেন। অনেক গবেষক ব্রত ও পূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসব আলপনাকে প্রাক-আর্য সময়ের নিদর্শন বলেও চিহ্নিত করেছেন। তবে, বর্তমান সময়েও একুশে ফেব্রুয়ারিসহ নানা জাতীয় দিবস উদযাপনেও আঁকা হয় আলপনা। আধুনিক এসব আলপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিমূর্ত, আলংকারিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ দিকে, লোকশিল্প গবেষকরা বলছেন, ‘আলপনার অতীতেও যেমন আবেদন ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও তা অটুট থাকবে।’

আমাদের উৎসব, পার্বণসহ নানা দিবসে আলপনার ব্যবহার থাকলেও এর নামে কোনো গ্রামের নামকরণ হতে পারে, তা একটু অবিশ্বাস্য বিষয়। তবে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের ‘টিকইল’ গ্রাম কিন্তু এখন ‘আলপনা গ্রাম’ নামেই পরিচিত। এই গ্রামের দেয়ালে দেয়ালে রঙের খেলা। ঘরে ঘরে ক্যানভাস। আর এই ক্যানভাসই এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের এ অজপাড়াগাঁয়ের গৌরব।

জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম টিকইল। এই গ্রামের অর্ধশতাধিক বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে আলপনার শোভা। বাইরের দেয়াল থেকে শুরু করে ভেতরের দেয়াল, বৈঠকখানা, বারান্দা, এমনকি রান্নাঘর- যেখানেই দেয়াল, সেখানেই রঙের ছোঁয়া।

বিভিন্ন উৎসবকে ঘিরে আঁকা হয় এসব আলপনা, যা দেয়ালে থেকে যায় সারা বছর। রঙ নষ্ট হলে আবারও দেওয়া হয় তুলির আঁচড়। ফলে রং-বেরঙের এসব আলপনা দেখতে অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন। তবে, এসব আলপনা কোনো শিল্পীর আঁকা নয়। বাড়ির গৃহিণীদের হাতের তুলিতেই এমন শিল্পকর্মের সৃষ্টি। বংশ পরম্পরায় সৌন্দর্যবর্ধন ও দেবতার সুদৃষ্টিসহ আশীর্বাদ কামনায় এ ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন টিকইল গ্রামের নারীরা।

নেজামপুর ইউনিয়নের হাটবাকইল বাজার থেকে উত্তর দিকের সড়ক ধরে এগোতেই চোখে পড়ে মাটির দেয়ালে ঘেরা সারি সারি বাড়ি। আঁকাবাঁকাভাবে গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে গেছে এই পাকা সড়কটি। সড়কের দুই ধারের সারি সারি এসব বাড়িগুলোর সবই প্রায় কাঁচা। আর এসব বাড়ির দেয়ালে আঁকা রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আলপনা। শুধু রঙিন দেয়ালগুলোর জন্যই এসব বাড়ি পথচারীদের নজর কাড়ে।

সড়ক ধরে কিছুদূর যেতেই চোখ আটকে গেল একটি বাড়ির দেয়ালে। বাড়িটি ছোট। তবে, বেশ পরিপাটি। জানা গেলে বাড়ির মালিক দাসু চন্দ্র বর্মণ, পেশায় দিনমজুর। সরকারি খাস জমিতে গড়ে তুলেছেন তিনি এ বসতবাড়ি। তবে, বাড়ির দিকে চোখ পড়লেই যে কারও ইচ্ছে হবে একটু দাঁড়িয়ে যেতে। কারণ, বাড়ির বাইরের দেয়ালে বিভিন্ন রং দিয়ে আঁকা রয়েছে ফুল, পাখি ও লতাপাতা। মেঝেটাও সুন্দর করে লাল মাটি দিয়ে রাঙানো।

বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা মিলল দাসু চন্দ্র বর্মণের স্ত্রী দেখন বালা বর্মণের সঙ্গে। কথা হয় আলপনা ও আলপনা গ্রামের বিষয়ে। তিনি জানান, মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। এখন বয়স ৫২। লেখাপড়া করার সুযোগ তেমন একটা পাননি। আর আলপনা আঁকার কৌশলও কারও কাছ থেকে শেখেননি তিনি। তবুও প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি এই কাজ করে রাঙিয়ে রেখেছেন নিজের চারপাশ।

তিনি বলেন, তার হাত ধরেই টিকইল গ্রামের অনেক মেয়ে ও গৃহবধূ আজ আলপনা আঁকায় হাত পাকিয়েছেন। ফলে আলপনার রঙিন উপস্থাপনায় পৌষ-পার্বণে বাড়ির দেয়ালগুলো হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় ও সুন্দর।

দেখন বালা আরও জানান, ‘ভালো লাগার জায়গা থেকে আলপনা আঁকা। এতে বাড়িঘর দেখতে ভালো লাগে। মানুষও ভালো বলে। প্রতি বছর আমি নকশা পরিবর্তন করি। পাশাপাশি যখন যেটা ভালো লাগে সেটাই আঁকি। প্রথম দিকে আলপনা আঁকার উপাদান প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতাম। এখন বাজার থেকে কিছু রং, খড়িমাটি, চুন কিনে কাজ করি।’

দেখান বালা বলেন, ‘দেবতার সুদৃষ্টি ও আশীর্বাদ কামনায়ও আমি আলপনা আঁকি। আমার বাড়িতে রাধাগোবিন্দ ও লক্ষ্মীর মূর্তি রয়েছে। প্রতিদিনই সকালে তাদের সেবা দিতে হয়। যার জন্য বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি।’

দেখন বালার পাশেই রণজিৎ বর্মণের বাড়ি। তার বাড়িও এমনই পরিপাটি। তিনি পেশায় দিনমজুর ও একজন কীর্তনশিল্পী। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল জ্যৈষ্ঠের খরতাপে বর্গাচাষের বোরো ধান বস্তাবন্দি করতে ব্যস্ত তিনি। এখানেও বাড়ির দেয়ালজুড়ে দেখা গেল বিভিন্ন আলপনা। জানা গেল, রণজিতের স্ত্রী অনিতা বর্মণ ও তাদের মেয়ে রিমা বর্মণ এঁকেছেন এসব আলপনা।

এ সময় অনিতা বর্মণ জানান, ‘সাদা মাটি, লাল মাটি ও চুন দিয়ে প্রথমে দেয়াল লেপন করা হয়। পরে আতপ চালের গুঁড়া, খড়িমাটি, বিভিন্ন ধরনের রং, শুকনো বরই চূর্ণ আঠা, মানকচু ও কলাগাছের কস দিয়ে তৈরি রঙের মিশ্রণ দিয়েই আঁকা হয় এসব আলপনা।’

একইভাবে অনিতা বর্মণের বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার পূর্ব পাশের কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে কথা হয় নয়ন মণি বর্মণ, বন্দনা বর্মণসহ অনেকের সঙ্গে। তাদের সবারই বসতঘর মাটির। তারা জানান, ‘পূর্বে আলপনা আঁকতে গিরিমাটি, চক (খড়িমাটি), লালমাটি, সাদামাটি, তারপিন তেল ব্যবহার হতো। তবে, সেগুলো বেশি দিন স্থায়ী হতো না। বর্তমানে শুকনো বরই চূর্ণ আঠা, গিরিমাটি, আমের পুরাতন আঁটির শাঁস, চকগুঁড়া, বিভিন্ন রং, মানকচু ও কলাগাছের কষ দিয়ে তৈরি রঙের মিশ্রণ চার থেকে পাঁচ দিন ভিজিয়ে রেখে রং তৈরি করা হয়। ফলে এই রং দিয়ে আঁকা আলপনা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়।

এ ব্যাপারে লোকশিল্প গবেষক শাহ নেয়ামতুল্লাহ কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক প্রভাষক কনক রঞ্জন দাস জানান, ‘আলপনা একটি আদি শিল্প। এই লোকজশিল্প বাঙালির শিকড়ে প্রোথিত। যদিও শহরে এর বিকাশ তেমন ঘটেনি, তবুও গ্রামাঞ্চলে এর প্রচলন ব্যাপক। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েরা প্রতিটি পার্বণেই বাড়িঘরের শোভাবর্ধনে চোখ জুড়ানো বিভিন্ন আলপনা আঁকেন। যা বাঙালি মেয়েদের শিল্পগুণের পরিচয়কে তুলে ধরে।’

তিনি বলেন, ‘যতদিন মানুষের সৌন্দর্য পিপাসা থাকবে, ততদিন বাঙালির হৃদয়ে আলপনা থাকবে। আলপনা তার শাশ্বত প্রতীকী বৈশিষ্ট্যের জন্য অতীতেও যেমন ছিল, বর্তমানেও তেমনি আছে এবং ভবিষ্যতেও এর আবেদন থাকবে।’

ওডি/আইএইচএন

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড