আদিল হোসেন তপু, ভোলা
ভোলার মনপুরা উপজেলায় সম্প্রতি একের পর এক ধর্ষণ মামলায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এসব মামলার কোনোটা হচ্ছে থানায় আবার কোনোটা আদালতে। আর স্কুলশিক্ষিকা থেকে শুরু করে কলেজছাত্রী ও দুর্গম চরাঞ্চলের গৃহবধূরা এসব মামলার ভিকটিম হচ্ছেন। এছাড়া মামলাগুলোর আসামিদের তালিকায় রয়েছেন- বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান, ছাত্রলীগ নেতাসহ স্কুলশিক্ষক এবং দুর্বৃত্তরা। ফলে বিষয়টি নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠায় রয়েছেন মনপুরার সাধারণ মানুষ।
এ দিকে, গত তিন মাসে মনপুরা উপজেলায় অন্তত আটটি ধর্ষণ মামলার ৩০ জন আসামি হলেও গ্রেফতার হয়েছে মাত্র তিনজন। ফলে বাকিদের গ্রেফতারে পুলিশের উদাসীনতা বিচার প্রত্যাশীদের হতাশ করছে।
গত ৭ সেপ্টেম্বর মনপুরা কলেজের ছাত্রী একই কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি রাকিবকে আসামি করে থানায় ধর্ষণের মামলা দায়ের করে। পরবর্তীকালে তার সহপাঠীরা মনপুরা ও ভোলায় সংবাদ সম্মেলন এবং মানববন্ধন করে সুষ্ঠু বিচার দাবি করে। কিন্তু এর ফলাফল এখনো শূন্য। পুলিশের আইনি কার্যক্রমেও চলছে ধীরগতি।
এর আগে মনপুরা উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি এনাম হাওলাদারকে আসামি করে স্কুলশিক্ষিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে একটি মামলা হয়। মামলার প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ তাকে বহিষ্কার করে। কিন্তু পুলিশ এখন পর্যন্ত তাকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি।
গত ২৬ অক্টোবর মনপুরা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের কর্মচারী নজরুল ইসলাম ও তার পাঁচজন সহযোগী এক গৃহবধূকে স্পিডবোট থেকে চরপিয়ালে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর পুলিশ নজরুলকে গ্রেফতার করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাকি আসামিদের একজনকেও খুঁজে পায়নি পুলিশ।
এর এক দিন পূর্বে গত ২৫ অক্টোবর মনপুরার কলাতলীর চরে এক মুক্তিযোদ্ধার নাতনিকে ধর্ষণ করে মো. বাবু নামের এক যুবক। তবে, স্থানীয় জনতা তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করায় বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে।
সম্প্রতি ৪ নভেম্বর মনপুরার মাস্টারহাটের এক যুবতীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের মামলা হয় সোনার চরের রাকিব সওদাগরের বিরুদ্ধে। মামলার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ওই যুবককে গ্রেফতারও করা হয়।
সর্বশেষ জানা গেছে, মনপুরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এরপর বর্তমান চেয়ারম্যান আমানত উল্যাহ আলমগীর ও স্কুলশিক্ষক ফারুক ফরাজীসহ আটজনকে আসামি করে মামলা হয় আদালতের নির্দেশে। এই মামলায়ও পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।
এ দিকে, এ মামলাটির বাদীকে পুলিশ মামলা প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দেয় এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ গালাগালি করে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে, এ ব্যাপারে মনপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাখাওয়াত হোসেন পুলিশ কর্তৃক বাদীকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগ কিংবা অসদাচরণের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
এভাবে একের পর এক ধর্ষণ মামলা হওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন মনপুরার মানুষ। পাশাপাশি আসামিরা গ্রেফতার না হওয়া কিংবা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। এ দিকে, ধর্ষণ মামলার আসামি মনপুরা ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর নিজেই বলছেন, ‘ধর্ষণ মামলার আসামীরা সবাই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ তবে, পুলিশ বলছে এসব মামলার কোনো কেনোটা মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। আবার কোনো কোনো মামলার আসামি পলাতক রয়েছে। এসবের মধ্যে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যদি মামলাগুলো মিথ্যাও হয়, তবে যারা মিথ্যা মামলা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কেন কেনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
এ দিকে, ধর্ষণ মামলার আসামি ছাত্রলীগ নেতা রাকিব বলেন, তার মামলাসহ মনপুরার ধর্ষণ মামলাগুলোর অধিকাংশই মিথ্যা। নোংরা রাজনীতির কারণেই এ মামলাগুলো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অপর একটি মামলার আসামি মনপুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর বলেন, ‘যে মহিলা আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে, তাকে আমি কোনো দিন দেখিও নাই, চিনিও না। তাহলে এ ধরণের ঘটনা ঘটার প্রশ্নই উঠে না। তারপরও সে নিজেই এখন অনুতপ্ত। আগামী ১৮ নভেম্বর সে মামলাটি প্রত্যাহার করে নিবে বলে আমি শুনেছি। যে বা যারা আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের মিথ্যা মামলা করেছে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব।’
একই মামলার আসামি কলাতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফারুক ফরাজী বলেন, ‘আমাদের হয়রানি করার জন্যই রাজনৈতিকভাবে এই ধর্ষণের মামলাগুলো দেওয়া হচ্ছে।
একইভাবে মনপুরার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন হাওলাদার জানান, ‘কাজীর চরের একটি মহল সাধারণ মানুষকে জমি বন্দোবস্ত দিবে বলে ব্যাপক হারে চাঁদাবাজি করেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে ওই চক্রটি।’ এ সময় কেউ প্রভাবশালীদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তারা প্রতিবাদী মানুষকে দমনে মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ ব্যাপারে ভোলা বারের আইনজীবী নজরুল হক অনু দৈনিক অধিকারকে জানান, ‘সব মামলাই যে সত্যি কিংবা সবগুলোই যে মিথ্যা এমন নয়। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা তা একমাত্র আদালতেই প্রমাণ হবে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে পুলিশের যে ভূমিকা আমরা দেখছি তা রহস্যজনক। এসব মামলাগুলোর মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ ফায়দা লুটছে। আবার কোনো ক্ষেত্রে গ্রামীণ রাজনৈতিক চক্র তাদের স্বার্থ হাসিল করছে।’
তিনি বলেন, পুলিশ ও স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক চক্রের মারপ্যাঁচে পড়ে প্রকৃত ঘটনাও পরিণত হচ্ছে মিথ্যা ঘটনায়। এমতাবস্থায় সুষ্ঠু সমাধানের দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে মনপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাখাওয়াত হোসেন দৈনিক অধিকারকে জানান, ‘আমি এই থানায় নতুন এসেছি। সবগুলো মামলার বিষয়ে এখনো বিস্তারিত জানি না। তবে, আদালত থেকে যেসব মামলা এসেছে সেগুলো মিথ্যা এবং রাজনৈতিক। তারপরও আমরা আমাদের দায়িত্বে যেটুকু আছে সেটুকু করব, বাকিটা আদালত দেখবে।’
ওডি/আইএইচএন
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড