• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

জীবন যেখানে থমকে দাঁড়ায়!

  রাহুল বিশ্বাস মুন্না

২০ জুলাই ২০১৮, ১৯:০৫
জীবন যেখানে থমকে দাঁড়ায়!
ছবি : ফ্লিকার থেকে সংগৃহীত

পৃথিবীতে বিশাল জনবহুল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পরিচিত একটি নাম। নানান সমস্যায় জড়িত বাংলাদেশ বর্তমানে অনেকের মধ্যে একটি প্রধান ও ভয়ানক সমস্যা হলো যানজট। এই দেশের অনেক এলাকায় কম বেশি যানজট দেখা দিলেও রাজধানী ঢাকায় সেটা মারাত্মক আকার নিয়েছে। যানজটের তীব্রতায় অতিষ্ঠ ঢাকা শহরের জনজীবন এবং বসবাস অনুপযোগী হয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার বাসিন্দারা। রাজধানীর ধারাবাহিক ও গতিময় যান্ত্রিক জীবন এখানে এসেই থমকে দাঁড়ায় যানজটের কারণে। দুর্ঘটনা, রাস্তার কাজ, নির্মাণমূলক কাজ, অবৈধ গাড়ি, অদক্ষ ড্রাইভার, ট্রাফিক পুলিশের অবহেলা মূলত যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ।

যানজট হলো- বিভিন্ন কাজে গাড়ির অচল অবস্থা এবং খুব ধীরে অনেক সময় ধরে নিয়মমাফিকভাবে না চলা। পৃথিবীর সকল দেশেই কমবেশি ট্রাফিক জ্যাম বা যানজট পরিলক্ষিত হয়। উন্নত দেশের তুলনায় অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে যানজটের আধিক্য লক্ষণীয়। যানজট নাগরিক জীবনে এক তীব্র যন্ত্রণার নাম। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নগরজীবন যেন এই যন্ত্রণার প্রতিবিম্ব।

দেশের বড় ছোট সকল শহরেই কমবেশি যানজট সমস্যাটি দেখা যাচ্ছে। তবে রাজধানী ঢাকা নগরীতে যানজটে সাধারণ জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। রাজধানীর বাইরে অন্যান্য শহরগুলোতে যানজট তীব্র না হলেও বিশেষ সময়ে ও বিশেষ কারণে কখনো কখনো মাত্রাতিরিক্ত হয়ে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ সড়কে দুর্ঘটনা ঘটলে যানজট প্রত্যক্ষ করা যায়।

রাস্তার বিভিন্ন ধরণের মেরামত কাজ, বর্ষাকালে রাস্তায় বিভিন্ন খানাখন্দের কারণেও তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের প্রধান দুইটি ধর্মীয় উৎসব ঈদের সময় সারাদেশে কমবেশি যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। অনুন্নত সড়ক ব্যবস্থা, দেশীয় গাড়ি, রাস্তায় ঘন ঘন রেলক্রসিং - এর কারণেও তীব্র যানজট তৈরি হয়। তবে শহরগুলোতে যানজট সমস্যা থাকলেও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল এ সমস্যা থেকে মুক্ত।

ঢাকা বাংলাদেশের সর্বাধিক জনবহুল শহর। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ায় এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সবই ঢাকা কেন্দ্রিক। দেশের অন্যান্য শহরের চেয়ে এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি হবার ফলে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ঢাকায় নিত্য বসতি স্থাপন করছে। বিশাল এ জনসংখ্যার প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত ঢাকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন যানবাহন।

অন্যদিকে অধিক জনসংখ্যার কারণে বাসস্থান ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা সুনিশ্চিত করতে রাস্তাঘাট হ্রাস পাচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত জনসংখ্যা ও যানবাহনের অধিক চাপ অপর্যাপ্ত রাস্তা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। যে কারণে সৃষ্টি হচ্ছে অসহনীয় তীব্র যানজট। যা যানজট বৃদ্ধিতে অন্যতম সহায়ক, ড্রাইভারদের আইন না মানার প্রবণতা, আগে যাবার প্রবণতা যানজট বৃদ্ধিতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে।

ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যাও যে পরিমাণ দরকার সিগনালে সেটা পরিমাণের তুলনায় খুবই স্বল্প। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় বেড়েছে অসাধু ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ নেওয়ার দৌরাত্ম্য। ঢাকায় যানজটের আরেকটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো পরিমাণের তুলনায় খুবই স্বল্প পাবলিক বাস। অন্যদিকে প্রয়োজনের তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস এ সমস্যাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। পথচারীরাও আইন না মেনে ইচ্ছামতো রাস্তা পার হয় ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে।

যানজটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়। ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ঠিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে পৌঁছাতে পারছে না। আধুনিক বিজ্ঞানের দ্রুত গতির আবিষ্কার জীবনকে গতিশীল করলেও যানজট সেই গতিতে ফিরিয়ে এনেছে নব্বইভাগ স্থবিরতা। রাষ্ট্রের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সবাইকেই এর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে কষ্ট হয়। এতে হাজার হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। গন্তব্যে পৌঁছাতে তড়িঘড়ি করার কারণে ঘটে দুর্ঘটনা।

যানজটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্ব ও জাতীয় অর্থনীতি। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ইউরোপে প্রতিবছর ২০০ বিলিয়ন ইউরোর চেয়েও বেশি অর্থ যানজটের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ইউরোপে এই অবস্থা ভয়াবহ। বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের তিন প্রকৌশলীর বিবৃতিতে ঢাকা শহরে যানজটের কারণে যে ক্ষতি হয় তার আর্থিক মূল্য প্রতিবছর প্রায় হাজার হাজার কোটি টাকা।

রাজধানী ঢাকায় যানজটে দিনে নষ্ট হয় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। বছরে এই কর্মঘণ্টা নষ্টের আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যে পরিমাণ অর্থ ক্ষতি হচ্ছে, তা দিয়ে বছরে অন্তত একটি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। আর এ টাকা দিয়ে বছরে সম্প্রতি উৎক্ষেপিত বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম স্যাটেলাইটের মতো প্রায় ১২টি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো যায়।

যানজট নিরসনে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফ্লাইওভার, ওভার ব্রিজ নির্মাণ করে রাস্তার পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। পরিকল্পনা করা হচ্ছে মেট্রোরেল ও উড়াল সেতু নির্মাণের। অধিকাংশ রাস্তাগুলোকে পাকা সড়কে রূপান্তর করা হচ্ছে। অনুন্নত ভাঙা ও খানাখন্দকপূর্ণ সড়কগুলোকে মেরামত করা হচ্ছে। তবে রাস্তাঘাটকে যানজট মুক্ত করতে আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

 ছোট রাস্তাগুলোকে যথাসম্ভব দীর্ঘ ও প্রশস্ত করতে হবে।  যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বন্ধ করতে হবে।  লাইসেন্সবিহীন যানবাহন বা অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে।  ট্রাফিক আইন আরো কার্যকরী ও ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।  ব্যস্ততম রাস্তায় রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং বন্ধ করতে হবে।  অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ বন্ধ করতে হবে।  রাস্তাগুলোকে বহু লেন বিশিষ্ট করে ধীর গতির ও দ্রুত গতির যানবাহনের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করতে হবে।  ঢাকা শহরে প্রাইভেট গাড়ির বদলে পাবলিক বাসের ব্যবস্থা করতে হবে।  বিভাগীয় শহরগুলোতে ঢাকা শহরের মতো উন্নয়ন অবকাঠামো বিস্তৃত করতে হবে।  ঢাকা শহরের বাইরেও নামিদামি স্কুল কলেজ স্থাপন করতে হবে।  বিভাগীয় শহরেও উন্নত চিকিৎসা কেন্দ্র, হোটেল, রেস্তোরাঁর ব্যবস্থা করতে হবে।  মিনিবাসের সংখ্যা কমিয়ে ডাবল ডেকার বাসের ব্যবস্থা করতে হবে।  রাস্তাগুলোতে পর্যাপ্ত ডিভাইডারের ব্যবস্থা করতে হবে।  বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ব্যাপক কর্মস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে যাতে সবাই শহরে জড়ো না হয়।  রাজধানী ঢাকার রাস্তা থেকে অবৈধ হকারদের উচ্ছেদ করতে হবে।  রেল যোগাযোগ ও নৌ-যোগাযোগের উন্নতি সাধন করতে হবে।  রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির যাতায়াতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হবে।  প্রাইভেট গাড়ি কিনতে নিরুৎসাহিত করতে উচ্চহারে ভ্যাট নির্ধারণ করতে হবে।

দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের আয়োজন এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় যানজটের কারণে পিক আওয়ারে গণপরিবহনের গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে, যেখানে পায়ে হেঁটে চলার গড় গতিও ৫ কিলোমিটার।

আধুনিক গতিময় সুন্দর এই জীবনকে আরো গতিশীল করতে যানজটমুক্ত জীবনের কোনো বিকল্প নেই। যানজট জনজীবনে শুধু অস্বস্তি আর দুর্ভোগের কারণ নয় বরং তা অর্থনৈতিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। অধিক যানজট বিশ্বের দরবারে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। তাই যানজট নিরসনে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড