হুমায়ুন কবির সূর্য্য, কুড়িগ্রাম
চোখে ক্ষীণ দৃষ্টি। বাম হাত রোগ-ব্যাধিতে শুকিয়ে গেছে। ঝাপসা চোখেই দেখা স্বপ্নগুলোতেও যেন মরিচা ধরেছে। ভোর ৬টায় বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর খলিল তেলির অন্ধকারাচ্ছন্ন ছাপরা টিনশেড ঘরে চলে তার অবিরাম ঘানি টানা। বলছি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পাণ্ডুল ইউনিয়নের পঞ্চাশোর্ধ শামছুলের কথা।
পাণ্ডুল বাজারের পাশেই তেরিপাড়ায় থাকেন। বাবা জমসের আলী মারা গেছেন অনেক আগেই। তিন কন্যা সন্তান ছিল। জন্মের পর মারা গেছে প্রথম সন্তান। দ্বিতীয় সন্তান জন্মের ৫ বছর পর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বর্তমানে একমাত্র মেয়েকে কোনোমতো বিয়ে দিয়ে বাড়িতে রয়েছেন স্ত্রীসহ। বসতভিটা ছাড়া তার আর কিছুই নেই। দিনে ৭০ টাকা উপার্জনে খুব কষ্ট করে সংসার চলে তার। তবে, মাসে সাতশ টাকা করে প্রতিবন্ধী ভাতা পান তিনি। তাও খরচ করেন সংসার টিকিয়ে রাখতে।
গত দুই বছর ধরে এভাবেই পাণ্ডুল বাজারের ইউনিয়ন পরিষদ ও পাণ্ডুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গেট সংলগ্ন খলিল তেলির অন্ধকারাচ্ছন্ন টিনশেড ঘরে ঘানি টানার কাজ করছেন তিনি। শামছুল ভোর ৬টায় আসেন এখানে আর ফেরেন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে। একটানা কষ্টকর সময়গুলো যেন শেষ হতেই চায় না তার। মাত্র ৭০ টাকা দিনমজুরিতেও এই কাজে বাধ্য হয়ে করছেন তিনি। কারণ অসুস্থতার কারণে গ্রামবাসী তাকে কাজে নিতে চায় না। ফলে পেটের দায়ে অল্প মজুরিতেই তাকে এই কাজ করতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে শামছুল হকের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ‘এই গরুটেই মোর বন্ধু। উয়ার (গরুর) সঙ্গে নানান কথা কও (বলি)। কন বাহে (আপনিই বলুন) এমন চরকি দিয়া ঘুরপাক কায়া (খেয়ে) কতক্ষণ থাকা যায়। পেত্থম পেত্থম (প্রথম প্রথম) মোর মাথা পাক দিয়া উঠত (মাথা ঘুরে উঠত)। ঘানি থাকি নামলে শরীর চরকি খায়া (ঘুরপাক খেয়ে) মাটিত পরি যাবার মতো অবস্থা। দুই-একদিনতো বমি করি দিবার ধরছং (বমি করা শুরু করেছিলাম)। হাত খারাপের জন্য কাঁইয়ো (কেউ) মোক (আমাকে) কামোত নিবার চায় না। এলা কাম না করি খামো কী (কাজ না করলে খাব কী)। শেষোত (অবশেষে) দুই বছর থাকি এই কাম করি খাবার নাগছন (এ কাজ করেই খাচ্ছি)।’
কথাগুলো বলেই শূন্য চোখে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। কারও কাছে তার নেই কোনো অভিযোগ কিংবা অভিমান। নিয়তি মেনেই এখন এই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। একটু ভালো থাকা, ভালো খাওয়া কিংবা ভালো পোশাক পড়া-এসব যেন কল্পনাতেও স্থান দিতে চান না সহজ সরল এই মানুষটি।
শামছুল ইসলাম আরও জানান, দিনে ৯ কেজি সরিষা ভাঙতে হয় তাকে। এই ৯ কেজি সরিষা থেকে উৎপন্ন হয় ৩ কেজি তেল। আর খৈল হয় ৬ কেজি। এতে মালিকের অর্থ আসে তেলে ৬শ টাকা এবং খৈলে ৩শ টাকা।
শামছুলের ব্যাপারে ঘানির মালিক মৃত. শহরুদ্দির ছেলে খলিলুর রহমান জানান, ‘অসুখের কারণে শামছুলের বাম হাত অচল। কাজ করতে পারে না। তবুও আমি তাকে কাজ দিয়েছি। নাহলে তাকে কাজ দিবে কে?’ এ সময় শামছুলের বেতনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ঘানি টেনে সব খরচ বাদ দিয়ে একদিনে থাকে মাত্র আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা। এ টাকা দিয়ে নিজেই ঠিকভাবে চলতে পারি না তাহলে তার বেতন কীভাবে বাড়াব?’
ওডি/আইএইচএন
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড