• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

লেখক-প্রকাশক দ্বৈরথ : একটি এড়িয়ে যাওয়া সত্য

  ওয়াহেদ সবুজ

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৫:৩৪
নতুন লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যকার শীতল সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ যেন লেখকদের পিছিয়ে পড়ার আগাম বার্তা; ছবি : সংগৃহীত

বছর ঘুরে আবার বাঙালির দুয়ারে হাজির হয়েছে বাঙালির প্রাণের উৎসব অমর একুশে গ্রন্থমেলা। উৎসবই তো! কেননা এখানে কেবল বই কেনাবেচাই হয় না বরং প্রতিবছর এই মেলা পরিণত হয় লেখক ও পাঠকের মিলন উৎসবে। পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বকালের বৃহত্তম ও দীর্ঘতম মেলাগুলোর একটি বাংলা একাডেমির আয়োজনে আমাদের এই অমর একুশে গ্রন্থমেলা।

বাংলা একাডেমি চত্বর পেরিয়ে মেলা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিস্তৃত। দিনে দিনে মেলার পরিসর যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বেড়েছে লেখক, প্রকাশক ও প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও। গত বছরেও মেলার মাত্র আটাশ দিনে নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে চার হাজারের উপর। সব মিলিয়ে গত দু-তিন দশকে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ বাণিজ্যিকভাবে উল্লেখযোগ্য হারে এগিয়েছে। পেশা হিসেবেও সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনা এখন অনেকেরই পছন্দের তালিকায়। প্রকাশনা শিল্পের এই যে ইতিবাচক উত্তরণ, সৃজনশীল লেখালেখির এই যে প্রসারণ এগুলো যেমনটা আশান্বিত করে, তেমনি একটি ব্যাপারে পশ্চাৎপদতা আমাদের আশঙ্কার মধ্যেও ঠেলে দেয়। আর তা হলো লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা।

আমাদের সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনা যে অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করেই আশার আলো দেখতে শুরু করেছে, সে বিষয়ে কারোরই কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। মূলত এ কারণেই লেখক ও প্রকাশকের মধ্যেকার সম্পর্ক-উন্নয়নের পথে নানাবিধ সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে যেমন শত শত নতুন লেখকের আবির্ভাব হয় এ মেলায়, আরেকদিকে প্রকাশকের জন্যও এটাই সুযোগ সারা বছরের রসদ জুগিয়ে নেয়ার। সবচাইতে বড় দুর্যোগটা আসলে নতুন লেখকদের ঘিরেই ঘটে থাকে। কেননা এদের বেশিরভাগই বই প্রকাশের খুঁটিনাটি বিষয়ে অবগত থাকেন না। তাছাড়া, নতুন লেখকের পক্ষে প্রকাশক খুঁজে পাওয়াটাও একটা জটিল কাজ। যেহেতু বড় বড় প্রকাশকেরা নতুন লেখকদের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী নন, তাই নতুন লেখকদের ক্ষেত্রে বড় কোনো প্রকাশককে রাজি করাতে হলে নানান রকম ‘গ্যারান্টি স্কিম’- এর ভেতর দিয়ে তাদের যেতে হয়। এই ‘গ্যারান্টি স্কিম’ যে কেবল ‘বড়’ প্রকাশকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয়, ছোট-বড়-মাঝারি সকল প্রকাশকই এখন এই ‘গ্যারান্টি’ চান। প্রকাশকদের পক্ষে অবশ্য যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। নতুন লেখকের বইতে বিনিয়োগ করার আগে তাকে শতবার ভাবতে হয়; কেননা সবার উপরে যেহেতু এটি একটি ব্যবসা, সুতরাং বিনিয়োগ তুলে নিয়ে আসতে পারাটা এখানে মৌলিক একটি লক্ষ্য বৈ কি।

পরিস্থিতি যেটা দাঁড়িয়েছে- নতুন লেখকেরা সাধারণত প্রকাশকদের কাছ থেকে দুধরনের প্রস্তাবনার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এর মধ্যে সবচাইতে প্রচলিত হলো সম্পূর্ণ নিজ খরচে বইটি ছেপে নেয়া। সাধারণত নতুন লেখকদের বই প্রথম মুদ্রণে মোটামুটি চারশ বা পাঁচশ কপি ছাপা হয়। এ লেখকদের একটা বড় অংশ আছেন যারা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে বইগুলো ছেপে নেন। এ ক্ষেত্রে বইয়ের প্রচার ও বিপণন সবই লেখকের ঘাড়ে গিয়েই পড়ে। দ্বিতীয় প্রস্তাবনাটি অবশ্য দৃশ্যত বেশ নিরীহ প্রকৃতির। এ ক্ষেত্রে চুক্তিটি হয় এ রকম যে, প্রকাশক নিজ খরচে সবগুলো বই ছেপে দেবেন, কিন্তু লেখককে অন্তত অর্ধেক পরিমাণ (ক্ষেত্রবিশেষে পরিমাণটা এর চাইতে বেশিও হয়) বই কিনে নিতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না এ দুটো ব্যাপারই একজন লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত নির্দয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপমানজনকও বটে। এতকিছুর পরেও আরও একটি ব্যাপার সবার অন্তরালে রয়ে যায়, সেটি হলো লেখকের রয়্যালিটি পাবার অধিকার। একজন লেখক বই ছেপে নিন বা নির্দিষ্ট পরিমাণ বই কিনে নিন, এর বাইরে বইমেলায় বা প্রকাশকের কাছে সংরক্ষিত কপিগুলোর মধ্যে যা বিক্রি হয় সেগুলো থেকে লেখকদের রয়্যালিটি পাবার ঘটনা আজকের দিনে খুবই বিরল বৈ কি। এ ক্ষেত্রে অবশ্য প্রকাশকদের একটি দারুণ ঢাল রয়েছে- ‘আপনার বই তো বিক্রিই হয় না’। দুঃখজনক ব্যাপার হলো এত বড় একটি শিল্প, অথচ বেশিরভাগ লেখকই জানতে পারেন না তাদের বই প্রকৃত অর্থে কত কপি বিক্রি হয়েছে। নতুন লেখকেরা অবশ্য রয়্যালিটির ব্যাপারটা প্রত্যাশাও করেন না; কেননা এদের বেশিরভাগের কাছেই নিজের একটি নতুন বই প্রকাশিত হওয়াটাই একটা বড় ঘটনা; অনেকটা স্বপ্ন পূরণের মতো ব্যাপার। তবে, নিয়মিত লেখকেরাও কি ঠিকমতো তাদের রয়্যালিটি বুঝে পান? হাতে গোণা কয়েকজন লেখক আর কয়েকটি প্রকাশনীর কথা বাদ দিলে উত্তরটি নিঃসন্দেহে ‘না’ হবে। সমস্যার গভীরতা বিবেচনায় এগুলো তো অতি স্বাভাবিক ঘটনা। প্রশ্ন হচ্ছে- মোট কত কপি বই প্রকাশক ছাপছেন, তার প্রকৃত সংখ্যাটাও কি লেখকের কাছে পৌঁছায়?

বলা হয়- পৃথিবীর সকল লেখক ও প্রকাশকের সম্পর্কই তেতো। প্রকাশক একজন্য ব্যবসায়ী, তিনি ব্যবসায়ের চিন্তাটাই সবার আগে করবেন; এটাই সঙ্গত। কিন্তু একজন লেখক মেধা, সময় ও শ্রম দিয়ে একটা কিছু সৃষ্টি করবেন, আবার সেটা বই আকারে প্রস্তুত করতে অর্থও ব্যয় করবেন; এটা কতটা সঙ্গত? এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতেই পারে যে লেখকের লেখাটা বিক্রয়োপযোগী কি না? তো, এটা নিশ্চিতের দায়িত্ব কার? পুরোদস্তুত ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার আগে প্রকাশকদের যে কিছুটা পাঠকও হওয়া প্রয়োজন এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় কি আছে?

এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি, অতীব জরুরি। ক্রমবর্ধমান এ প্রকাশনা শিল্পের ভিত আরও মজবুত করে তুলতে এবং এর অগ্রসরমানতা আরও ত্বরান্বিত করতে লেখক ও প্রকাশকের মধ্যেকার সম্পর্ককে আরও সুসংহত, আরও উষ্ণ, আরও স্বচ্ছ করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। সামনের দিনগুলোতে এই আমাদের প্রত্যাশা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড