জোবায়ের মিলন
একটি লেখা তৈরি করবো বলে বইমেলায় এসেছি। বই নিয়ে লেখাটা। কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গে খোশ-গল্প করতে করতে ভেতরের কথা জানার চেষ্টা করছি। কিছু কথা জানছি। হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ করছি পাঠককে। স্টলে স্টলে দাঁড়াচ্ছি। যে স্টলে পাঠকের ভিড় সে স্টলের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে তাদের পিছু চলছি। কিছু কথা বলবো বলে। বেশিক্ষণ দাঁড়ালে বিক্রেতারা প্রশ্ন করছে, কোনো বই কি আছে পছন্দের? দেখুন না এটা বেশ চলছে, ওটা খুব ভালো! না সূচক মাথা নাড়ছি। যে পাঠকের দিকে খেয়াল রাখছি তার বই কেনা শেষ হলে কয়েক পা এগিয়ে তার কাছে জানতে চাচ্ছি এটা-ওটা যা আমার প্রয়োজন।
পাঠকে যতটা সরল ভাবতাম তারা ততটা সরল না, তারা বিচক্ষণ। তারা চুপচাপ মেলায় ঘুরলেও, নীরবে বই কিনলেও বই, প্রকাশনী, বাংলা একাডেমি, মোড়ক, পৃষ্ঠা, লেখা সম্পর্কে তাদের অনেক ভালো কথা, অনেক মন্দ কথা, অনেক অবলোকন আছে কিন্তু তারা কাকে বলবে, বলতে চাওয়া কথা? তারা জানে। বলে কতটুকু লাভ হবে সে সম্পর্কে তাদেরে আত্মবিশ্বাস নেই বলে তারা তাদের কাজটুকু করে আসছে, চলে যাচ্ছে।
একজন পাঠক তো বলেই ফেললো, ‘বেশিরভাগ লেখা অগোছালো। অমর একুশের গ্রন্থমেলা; একুশের ছোঁয়া কই?’ তাই তো! চোখ ঘুরাচ্ছি। চোখে পড়ছে না কিছু। সালাম রফিক শফিক জব্বার বরকতকে মনে পড়ছে। গত বছরও তাদের দেখেছি। এবছর নেই। কেন? জানি না। লেখাটির জন্য লিটলম্যাগ সম্পাদক দরকার। কথা বলা প্রয়োজন। কয়েকজনের সাথে দেখা। প্রশ্ন করে করে জেনে নিচ্ছি জানার কথা। তারা কথায় বেশ মেধাবী। মননশীলও। সৃজনশীল বলেই তারা লিটলম্যাগ করে, পরিশ্রম করে প্রকাশ করে প্রচলিত স্রোতের বাহিরে প্রতি-স্রোতশক্তির পুস্তক। এক-একটি চেহারাই বলে দেয় নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ভাঙ্গা চোয়ালের নিচে তাদের রয়েছে পুষ্ট জ্ঞান।
অন্তত আমার চেয়ে অধিক। বাঁক ঘুরি। ‘লেখক বলছি’ মঞ্চের দিকে হাঁটছি। মঞ্চটা ভালো লাগছে। রোজ কত গুণী লেখক আসছে! কত লেখক তার জীবনের কথা, লেখার কথা, লেখক হয়ে ওঠার কথা, হয়ে উঠে তা সামলে রাখার কথা, ভালো আর মন্দলাগার কথা বলছে! শুনছি। বইমেলায় একেবারেই তরুণ লেখকদের কি এমন সুযোগ আছে? থাকলে কেমন হতো? না থাকায় কেমন লাগছে? শুনতে শুনতে ভাবছি।
নতুনদের সৃজনশীলতা পাঠকের কাছে পৌঁছানোর কোন মাধ্যম বা সেতু কি মেলার অভিভাবকেরা তৈরি করেছেন! করলে কোন দিকে? একদিন শুনবো নতুনের কথা। নতুনই তো প্রাণ। নতুনরাই তো পুরাতন হবে। প্রতিনিধিত্ব করবে। একজন বয়স্ক লোক এসে পাশে দাঁড়ালেন। প্রবীণ, পরিপাটি, ভদ্রলোক। হাতে একটি কাগজের বাক্স। ‘আমাকে একটু সাহায্য করুন।’ চোখ ফিরিয়ে নিয়েও তাকাতে হলো ওনার বেশ বয়সের জন্য। দেখছি বাক্সের গায়ে লেখা, ‘আমি নিরুপায়। সাহায্য করুন।’
টোকন ঠাকুরের কথা থেকে মন চলে এসেছে লোকটির দিকে। উঠে দাঁড়িয়েছি। লোকটি বেশি সময় দাঁড়ালেন না ‘লেখক বলছি’এর চত্ত্বরে। উনি যে দিকে চলছেন আমি ওনার পাশে পাশে চলছি। লোকটি সবার কাছে সাহায্য বা বাক্সটি পেতে দিচ্ছেন না। মাঝে মাঝে, ফাঁকে ফাঁকে! কারো কারো কাছে। পকেট থেকে দশ টাকার পুরনো একটি নোট টেনে বাক্সে রাখলাম। - কাকা একটু কথা বলা যাবে? - হ্যাঁ - এই দিকটায় আসবেন? মাওলা ব্রাদার্স এর প্যাভিলিয়নের একটু দূরে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালাম। নির্জনে। - আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভিক্ষুক না, অসহায়, ঠিক? - ঠিক। - আপনার কেউ নেই? ছেলে, মেয়ে? - আছে। - তবে?...হলো অনেক কথা। জানা গেল বিকেল পৌঢ় লোকটির দু’ই ছেলে। এক ছেলে নেশা করে দিক হারা। ভবঘুরে, ভারসাম্যহীন। বড় ছেলে সুস্থ। ওমানে বসবাস রতো। স্ত্রী সমেত। কোনো মাসে অর্থ পাঠায় কোনো মাসে পাঠায় না। কোনো ফোন নম্বর দেয় না। ঠিকানাও। স্বজনেরা দেখতো আগে। এখন না। কোনো কোনো মাসে বা মাঝে মাঝে হার্ট, ডায়াবেটিকস, উচ্চ রক্তচাপ-এর ওষুধে টান পড়লে তিনি সাহায্য চান। সবার কাছে চান না। ভদ্র মনে হলে চান। কিছু টাকা পান কোনো সময়, সামান্যের বেশি পান না মাঝে মধ্যে। শরীর ঘামছে। পানি তৃষ্ণা লেগেছে। আমি একটু দূরে। পানি, আমার থেকে আরও একটু দূরে।
- কিছু খাবেন কাকা? মনে মনে বললাম। আমার পকেটে পাঁচটা দশ টাকার নোট মাত্র। ঘরে ফিরতে দরকার সাতটা দশ টাকার নোট। আরও একটি দশ টাকার নোট লোকটির বাক্সে দিলাম। - আপনি ক্লান্ত হলে আমার দেয়া টাকাটা দিয়ে আপনি দু’কাপ চা খাবেন। আপনাকে সাহায্য করার মতো আমারও সচ্ছলতা নেই আজকে। চারজন লেখকের সাথে কথা বলে তবে বইমেলা থেকে বের হতে হবে। লেখাটা রাতের মধ্যে দিতে না পারলে মান থাকে না। লেখক খুঁজছি। কোথায় লেখক? প্রকাশিত গ্রন্থের মালিক চোখে পড়ছে কয়েকজন। আমার লেখক দরকার। আমি হাঁটছি পাঠকের, দর্শনার্থীর, উৎসুকের ভিড় কেটে। আমার চারজন লেখক দরকার। কথা বলবো। জানতে চাইবো- নেশাকে না করতে পারে, নেশার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, নেশাকে না ছড়াতে পারে বা মানবিক ও মানসিক বিবেক বোধের কোন বই কি আছে আপনার লেখা? পৌঢ় বাবাকে প্রতি মাসে নিয়ম করে টাকা পাঠায়, ফোন নম্বর দেয়, ঠিকানা দেয়; আজ কেমন আছো বাবা? কী খেয়েছো মা? রোজ জিজ্ঞেস করে এমন মানুষ গঠনের, মন-মনন গঠনের, সমাজ-রাষ্ট্র-জাতী গঠন বোধসমৃদ্ধ কোন বই কি আছে বইমেলায়! নাকি স্রোতের অনুকূল আর সখিনা, জরিনার সাথে সেল্ফি প্রেমেরের অমর গাঁথায় পূর্ণ গ্রন্থ? আমি হাঁটছি। তাড়াতাড়ি। মেলার বেলা প্রায় শেষ। বেরুতে হবে। মাথায় ঘুরছে- ফোন নম্বর দেয় না! ঠিকানা দেয় না, খোঁজ নেয় না! বাক্য কয়েকটি....
ভেতরে কে যেন একটা প্রশ্ন করছে বারর বার, আচ্ছা মিলন, মাঠের পর মাঠ জুড়ে বইমেলা সাজিয়ে, মাথা পিছু আয় বাড়িয়ে, শহরময় ফ্লাইওভার বানিয়ে, ব্যাগ ভর্তি বই পড়িয়ে কী লাভ! যদি একজন পিতাকে দানবাক্স নিয়ে ঘুরতে হয় দ্বারে দ্বারে? একজন স্নেহের সন্তানকে যদি চলে যেতে হয় নেশার করাল গ্রাসে, আরেকজন সন্তানে যদি ভুলে যেতে হয় প্রবীণ মা-বাবাকে, ভুলে হয়ে ওঠে যদি পাথর পাষাণ, অকৃতজ্ঞ, অবোধ, অমানুষ? দোয়েল চত্ত্বর ধরে নূর হোসেন চত্ত্বর-এর দিকে হাঁটছি, একা।
আরও পড়ুন : আমার গ্রন্থমেলা (প্রথম পর্ব)
মনে হলো- শিক্ষিত, সভ্য, আধুনিক, অত্যাধুনিক নাগরিকের সমাগমে এমন প্রবীণ পুরুষেরা কিসের প্রতীক! চলমান হাজার হাজার বই কি আমাদেরকে লেখক, পাঠক, প্রকাশক হতেই প্রেরণা দিচ্ছে, নাকি প্রেরণা দিচ্ছে মানুষের মতো মানুষ হতে? কোনটি? আমরা কি টের পাচ্ছি কিছু?
ওডি/এসএন
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড