• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রাঙ্গণেমোর প্রযোজনা- হাছনজানের রাজা : কিছু কথা, কিছু অনুভূতি

  নির্ঝর আহমেদ প্লাবন

২০ মার্চ ২০১৯, ০১:৪৮
প্রাঙ্গণেমোর প্রযোজনায় হাছনজানের রাজা
ছবি : সংগৃহীত

হাছনজানের রাজা নাটকটি প্রথমবারের মতো মঞ্চে উপভোগ করলাম। তাও আবার নিজের প্রতিষ্ঠানে। আনন্দে ব্যাপক পরিশ্রম করেছি। দেখার সময় বেশ কিছু ভুলও প্রত্যক্ষ করেছি। আবার দেখার পর রাতে আনন্দে ঘুমাতে পারিনি। নাটকের তিন ঐক্য (সময়+স্থান+ঘটনা) সমন্বয় করতে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে নাট্যকর্মীদের। এখানে কিছুটা ভ্রান্তি তাদের থেকেই গেছে। মাঝির বর্ণনায় হাছনরাজার চরিত্রের নানা দিক জীবন্ত করার চেষ্টা করেছেন নাট্যকার ও নট-নটিরা। সফল নাটকের যে বৈশিষ্ট্য তার সবগুলো দিক না মেনেও একটি নাটক যে মানবের মগ্ন চৈতন্যে প্রবল ঝড় তুলতে পারে এটি তার একটি। হাছনরাজার চরিত্রের নানা দুর্বলতার পরও মানুষ তার জন্য কাঁদে। সিলেটের হাওড় অঞ্চলের মানুষদের মুখে মুখে কিংবদন্তি হয়ে টিকে আছেন হাছন রাজা। মানবের মানবীয় গুণাবলির সবগুলো রূপ এখানে অপরূপ হয়ে ফুটে উঠেছে।

আধুনিক যুগের তরুণ-তরুণীরা মাঝির কাছে হাছন রাজার গল্প শুনতে শুনতে একবার তাকে ভালোবাসে, একবার ঘৃণা করে, অরেকবার অবজ্ঞা করে, অন্যবার তার জন্য কাঁদে আর শেষে হাছন রাজার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়। হাছন রাজার মানসিক পরিবর্তন তরুণদের তারুণ্যের উদ্দীপনাকে স্থবির করে দেয়। তারা অতীতমুখী হয়ে ওঠে। অতীতের হাতছানি তাদেরকে টেনে নিয়ে যায় অনাবিল সৌন্দর্যের স্বপ্নীল বন্দরে। তারা খুঁজে পায় নিজ অস্তিত্বকে। খুঁজে পায় নিজের জীবন দেবতাকে। খুঁজে পায় নিজের ভেতর নিজের ইশ্বরকে। তখন অনতাল হক আর আনাল হকে কোনো তফাৎ থাকে না। তখন প্রিয়া আর ইশ্বর এক রূপ ধারণ করে। যে প্রিয়া সেই ইশ্বর, যে ইশ্বর সেই প্রিয়া। তখন নি‌র্দিষ্ট কোনো কেবলা থাকে না; চতু‌র্দিকেই আল্লাহকে পাওয়া যায়। সবচেয়ে বে‌শি পাওয়া যায় আপন অন্তরে। ভাববাদী বাঙালি সমাজের চিরায়ত মনস্তত্বকে নিপুণ কৌশলে উপস্থাপন করেছে নাট্যকার। সুফিবাদী দার্শনিক মনসুর হাল্লাজের চিন্তার বাস্তব প্রয়োগ এখানে দেখানো হয়েছে। ‌দেখানো হয়েছে আল্লামা রু‌মির দর্শন। ভারতীয় আর ইরানীয় সংস্কৃ‌তির প্রবল ঐক্য এখানে সংস্থা‌পিত হয়।

কিছুটা অমূলপ্রত্যক্ষ মায়া (হ্যালুসিনেশন), কিছুটা যাদু বাস্তবতা আর কিছুটা আবছা ছাপ আছে পরাবাস্তবতার। সর্বোপরি সুফিবাদী দর্শনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি হয়েছে নাটকের। একটি নাটকে এতগুলো দার্শনিক মতবাদ একসঙ্গে ফুটিয়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রায় অসম্ভব কাজকে একেবারে সম্ভব কাজে পরিণত করেছে ‘প্রাঙ্গণেমোর’ নাট্যদলের কর্মীরা। মৌ-লোভী মৌলবিরা এ নাটক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। কিন্তু রাতের আঁধারে নিজেও এই চিন্তায় মশগুল হতে পারে। জীবনকে খুঁটে খুঁটে জীবনের তিক্ত রূপগুলো বের করে এনে মানুষকে করুণ রসে সিক্ত করে নাট্যকার।

এখানে দৃশ্যমান হয়েছে হাছন রাজাকে নিয়ে তৈরি মিথগুলো। মূল হাছনরাজাকে না পাওয়া গেলেও লোকমুখে প্রচারিত ও জীবন্ত হাছন রাজা এখানে উপস্থিত হয়েছেন। নাচের মুদ্রাগুলো গতানুগতিক। গতানুগতিক হলেও কারো বিরক্তির উদ্রেক হয় না। গতানুগতিকতার আলাদা একটা শক্তি আছে, টান আছে; যা বানের স্রোতের মতো আকর্ষণীয়। যা মানুষকে শুধু ভালোবাসতেই শেখায়। গতানুগতিকতাকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে নট-নটীরা। এরা জীবনকে দেখতে চায়, জীবনকে জানতে চায়, আবিষ্কার করতে চায় জীবনের ভেতরে লুকায়িত জীবনকে। এরা মজে প্রেম রসে, এরা ভজে প্রেম রসে, এরা মাতে প্রেম রসে। মাঝি এদের নিয়ে যায় রূপকথার জগতে। মাঝি শুধু নৌকায় ভ্রমণ করায় না, ইতিহাসের অলিতে-গলিতেও ভ্রমণ করায়। মাঝিই এখানে বিবেক হয়ে উঠেছে। মাঝিই সেতুবন্ধন তৈরি করেছে অতীত-বর্তমানের।

নাটকের বিচিত্র ঘটনার ফাঁকে ফাঁকে হাছন রাজার বংশ পরিচয় তুলে ধরে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে নাট্যকার। লোক বিশ্বাস এবং হাছন রাজার জীবন ও দর্শন উপস্থাপনায় অভূতপূর্ব সাফল্য সবারই নজর কেড়েছে। পুরুষ ও নারীর দৈহিক কাঠামো অনুসারে তার চরিত্র নির্ণয়ের প্রাচীন প্রথা নতুন করে আমাদের ঐতিহ্য সচেতন করে তোলে। উত্তরাধুনিক নাটকের বৈশিষ্ট্য এখানে ব্যাপকভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। একটি নাটক একটি জীবনালেখ্য, একটি নাটক একটি ইতিহাস, একটি নাটক একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা, একটি নাটক একটি বিশেষ সময়ের প্রামাণ্য দলিল। এ আপনি কী করলেন শাকুর মজিদ ভাই? আমরা দেখলাম, ভাবলাম, নাট্যসমুদ্রে ডুব দিলাম, সেখান থেকে মণি-মুক্তা আহরণ করে অভিভূত হলাম আর বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘরে ফিরলাম। ঘরে ফিরে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম আর রাত্রির নিদ্রাকে ছুটিতে পাঠালাম।

মানুষ যত খারাপই হোক সে তার মাকে কখনো ভুলতে পারে না। তার মায়ের মুখ তাকে খারাপ কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এই অমোঘ সত্যকে প্রমাণ করার একটা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা এখানে লক্ষণীয়। মুনির চৌধুরী তাঁর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকে লিখেছিলেন- ‘মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়’। মুনির চৌধুরীর এই উক্তির সার্থক প্রয়োগ করা হয়েছে হাছন রাজার চরিত্রে। হাছন রাজা মায়ের মৃত্যুতে বদলে গেছেন। বাবার মৃত্যুতেও বদলে গিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুতে তিনি হয়েছিলেন বিলাসী, মায়ের মৃত্যুতে হলেন উদাসী। এ ভয়ঙ্কর সত্য শিল্পিত মানুষের রাতের ঘুম হারাম করে দেয়।

চার প্রকার অভিনয়ের কথা বলা হয় অভিনয় শাস্ত্রে। এগুলো হলো আঙ্গিক, বাচিক, সাত্তিক ও আহার্য। আঙ্গিক, বাচিক এবং আহার্যে কিছুটা দোষ শিল্পিত চোখ মাত্রই ধরে ফেলতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন যে কাজ সাত্তিক অভিনয়। এই জায়গায় এসে ‘প্রাঙ্গনেমোর এর গেরিলা শিল্প যোদ্ধারা অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন। সাত্তিক অভিনয়ে সর্বোচ্চ মার্গে আরোহণ করার কারণে অনেকগুলো দোষ সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিতে আসার সুযোগই পায়নি।

খোলা কণ্ঠে ৫০০ সিটের একটি মিলনায়তনের সব দর্শকের কাছে সংলাপ সমানভাবে পৌঁছানোর কৃতিত্ব তারা দাবি না করলেও দর্শক দিতে বাধ্য হবে। তবে সূত্রধরের কিছু সংলাপ স্পষ্ট হয়নি। কিছু নারীর একটা দুটো করে সংলাপ হালকা ফসকে গেছে। দু-একজন নারী চরিত্র হঠাৎ হঠাৎ অতিরিক্ত অভিনয় করার চেষ্টা করেছে। সূত্রধরকে চিনতে দর্শকের অনেক সময় লেগেছে। তবে মূল নায়ক সবকিছুকে ছাড়িয়ে উঠেছেন। দর্শককে তাঁর সঙ্গে ভ্রমণ করাতে পেরেছেন।

ঘটনাটি যে নৌকায় ঘটেছে তা অনেকটা অস্পষ্ট থেকে গেছে। সেট ডিজাইন আরো আকর্ষণীয় হতে পারতো। আলোর বিন্যাস ততটা ভালো হয়নি যতটা অভিনয় দাবি করেছিলো। নায়ক একবার গানের পংক্তি ভুল করেছিলেন পরে অভিনয় দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করলেও দর্শক ঠিকই বিষয়টা বুঝে ফেলেছে। অভিনয় দারুণ হলেও আরো মুন্সিয়ানা দেখানোর সুযোগ ছিলো।

বর্তমানের সঙ্গে অতীতের একটা যোগসূত্র স্থাপন করেছেন নাট্যকার। আমরা হেঁটে গেছি অতীতের বিরান পথে। আমাদের যাত্রা নিরুদ্দেশের দিকে। আমরা সুন্দরের মোহনায় মিলতে পেরেছি। নতুন স্বপ্নের ঘোর তৈরি হয়েছে আমাদের মননে। অবচেতন মনে একটা প্রবল ধাক্কা অনুভব করেছি। দেখেছি জীবন কেমন করে রূপ বদলায়। রঙের জীবন কেমন করে ধূসর হয়ে ওঠে; আর ধূসর জীবনকে কেমন করে রঙিন রূপে দেখা যায় তা আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। বোধের অতলে কেমন একটা টান অনুভব করলাম। বুঝতে পারলাম না এ কিসের টান! তবে কেন জানি মনে হলো নিজ সংস্কৃতির টান বুঝতে হয় না শুধুই উপলব্ধি করতে হয়।

নাট্যকার শাকুর মজিদ, নির্দেশক অনন্ত হীরা, মূল নায়ক রমিজ রাজু, সূত্রধর আউয়াল রেজাসহ সকল অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদলকে স্যালুট না জানিয়ে পারলাম না। অনেক ছোট ছোট ভুল নিয়েও একটা নাটক যে মানুষকে মগ্নতা থেকে মুগ্ধতায় নিয়ে যেতে পারে তা তাঁরা দেখাতে সক্ষম হলেন। সর্বাঙ্গ সুন্দরের কাছকাছি গিয়েও কি যেন নাই , কি যেন নাই, এমন একটি হাহাকার নিয়েই শেষ হলো। মনে হলো রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কবিতার মতো ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী’।

অসাধারণ নাটকীয়তা আনয়ন করে জীবনকে ভরিয়ে তুললো কানায় কানায়। প্রাঙ্গণেমোর আমাদের পথ হাঁটিয়েছে। আমরা হেঁটেছি। কত দূর হাঁটলে পথিক বলা যায়- তা ভাবিনি কেউই। শুধু হেঁটেই চলেছি অজানা গন্তব্যে। রবি ঠাকুরের ভাষায়- “আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী! বল কোন্ পাড় ভিড়িবে তোমার সোনার তরী?” নজরুলের মতো করে বলতে ইচ্ছে করছে- “উড়ে যেতে চায় প্রাণ দূরে আরো দূরে সীমাহীন নিরুদ্দেশ পথে মাঝি ভাসে তুমি ভাসো আমি ভাসি স্রোতে”

সত্যিই আমাদেরকে স্রোতে ভাসিয়ে দিলো প্রাঙ্গণেমোর। এখন শ্যাওলা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছি। এখান থেকে আমাদেরকে কে কূলে ভেড়াবে প্রিয় শাকুর মজিদ? আপনার নির্দেশক অনন্ত হীরার বিচার চাই। কেন তিনি আমাদেরকে অস্তিত্ব সংকটে ফেললেন? তবে আবারও স্যালুট জানাই প্রাঙ্গণেমোরকে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড