নাবিলা বুশরা
"বীরাঙ্গনা লজ্জার নয়, গর্বের।'' নিজেকে প্রকাশ্যে বীরাঙ্গনা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া প্রথম মুক্তিযোদ্ধা তিনি। মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পর পেয়েছেন 'মুক্তিযোদ্ধা' স্বীকৃতি। তবুও অভিযোগ করেননি, করেননি অনুযোগ। নিভৃতে নিজের কাজ করে গেছেন মৃত্যু পর্যন্ত। বলছিলাম মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কথা।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী (ছবি: সংগৃহীত)
মুক্তিযুদ্ধের নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতা নিয়ে ডয়চে ভেলেকে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেছিলেন, ‘‘আমি বিজয় দেখেছি। যুদ্ধের নয়টি মাস যে কেমন ছিল সেটা আমি কখনোই ভুলতে পারি না। আমি বুঝতে পারি না যে যুদ্ধ হবে সেনাবাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীর, তবে কেন এই সাধারণ বেসামরিক মানুষের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর ন্যক্কারজনক আচরণ এবং আক্রমণ? চোখের সামনে নারকীয় দৃশ্য! যেখানে-সেখানে মা-বোনদের ধর্ষণ! কখনো গণধর্ষণ! চারদিকে নির্যাতনের শিকার নারীদের আর্তচিৎকার। আলোহীন প্রকোষ্ঠে প্রতিনিয়ত কতগুলো অসহায় নারীর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া। হত্যাসহ সাধারণ মানুষের বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া– এসব কিছুই দেখেছি আমি। এ যেন সভ্য পৃথিবীর বাইরের অন্য কোনো জগৎ!''
১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনায় নানার বাড়িতে জন্ম নেন ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী। বাবা সৈয়দ মাহবুবুল হক এবং মা রওশন হাসিনার ১১ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। প্রিয়ভাষিণীর নানা অ্যাডভোকেট আব্দুল হাকিম কংগ্রেস করতেন। ১৯৫২ সালে সুপ্রিম কোর্টে নানার কাজ করার সুবাদে ঢাকায় আসতে হলে তাঁর পরিবারের সাথে প্রিয়ভাষিণীও ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে। পরবর্তীতে নানা মিন্টু রোডের বাসায় চলে এলে প্রিয়ভাষিণী সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। সে সময় শহীদ জাহানারা ইমাম ছিলেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। পরে তিনি খুলনার পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি এবং খুলনা গার্লস স্কুল থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রি পাস করেন।
পড়াশোনা শেষে ১৯৬৩ সালে খুলনার আগা খান স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। পরে স্কুলের চাকরি ছেড়ে একটা পাট কারখানায় অভ্যর্থনা ডেস্কে কাজ নেন প্রিয়ভাষিণী।
১৯৭১ সালে প্রথম স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হলে যুদ্ধের সেই ভয়াবহতার মাঝেও সন্তানদের নিয়ে একা বেঁচে থাকার কথা ভাবছিলেন প্রিয়ভাষিণী। জীবনযুদ্ধের এই কঠিন সময়েই তিনি শিকার হন পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের।
ডয়চে ভেলের সে সাক্ষাৎকারে প্রিয়ভাষিণী আরও বলেছিলেন, 'সংসারের বড় একটি দায়িত্ব আমার উপর থাকায় দায়ভার সামলাতে আমাকে চাকরি নিতে হয়েছিল পাটকলে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যখন শহর ছেড়ে যাচ্ছিলাম ঠিক সে সময়ই ৭ এপ্রিল প্রথম পাক বাহিনীর বর্বরতা নিজের চোখে দেখি আমি। আমার চোখের সামনে প্রায় ১০০ গজের মধ্যে ১৪ জন মানুষকে হত্যা করতে দেখেছি আমি।
আমরা কয়েকজন মিলে যে বাড়িতে লুকিয়েছিলাম তার সামনে দিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের গাড়িও ঘুরে যায়। আমাদের উপস্থিতি বুঝতে না পারায় সে যাত্রায় বেঁচে যাই আমরা। এরপর সেখান থেকেও আমাদের পালাতে হয়েছিল। সে সময় তিনটি ছোট শিশুর ভার আমার উপর এসে পড়ে। ওদেরকে খাওয়ানোর মত পয়সা আমার কাছে ছিল না। একজন ব্যবসায়ী লোকের কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে নিয়ে বাজার থেকে দুধ কিনে এনে সেই শিশুদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি আমি। এরপর আমিসহ কয়েকটি পরিবার আশ্রয় নেই দৌলতপুরের কাছে একটি মুরগি খামারের পাশের নির্মাণাধীন বাড়িতে। কিন্তু সেখানেও আমরা থাকতে পারিনি বেশিদিন।'
'যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগে স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটায় সামাজিকভাবে সব জায়গা থেকেই নিগৃহীত ছিলাম আমি। কোনও উপায় না পেয়ে আবার আগের সেই পাটকলে যোগ দেই আমি। চাকরীতে যোগদানের পর থেকে আমি সেখানেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। সেই কারখানার কর্মকর্তাদের কাজ ছিল প্রতিদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ডেকে এনে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাদের হাতে আমাকে তুলে দেয়া। এরপর ২৮ অক্টোবর তারা আমাকে ধরে নিয়ে যায় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানে আরও কিছুদিন অবরুদ্ধ থাকার পর অনেক অনুনয়ের পর পাটকলের কোয়ার্টারে ফিরে আসি।'
এতকিছুর পরেও সহজে রক্ষা পাননি প্রিয়ভাষিণী। পাক বাহিনীর পরাজয়ের শেষ পর্যায়ে তাঁকে হত্যার জন্য তাঁর বাড়িতে হানা দেয় পাক সেনারা। ভাগ্য সহায় থাকায় সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। মাত্র দেড় মিনিটের ব্যবধানে ঘর থেকে বের হতে পারায় সে যাত্রায় জীবন রক্ষা হয়েছিল প্রিয়ভাষিণীর। তাঁকে সে ঘরে না পেয়ে সেখানে থাকা অন্য এক লোককে সেখানেই হত্যা করে পাক সেনারা।
১৯৭২-৭৭ সাল পর্যন্ত প্রিয়ভাষিণী একজন সাধারণ গৃহবধূর জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর পুরো সংগ্রামী জীবনে তিনি যেমন কারখানায় কাজ করেছেন, তেমনি যুক্ত ছিলেন ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, এফএও, ক্যানাডিয়ান দূতাবাস প্রভৃতি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সাথেও। শেষ দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন নানা ধরনের শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে।
ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর তৈরি ভাস্কর্য (ছবি: দ্য ডেইলি স্টার)
স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসার আগে মফস্বলে থাকতেন প্রিয়ভাষিণী। সেখানে নিজের বাগানে পড়ে থাকা অবহেলিত কাঠ, শিকড়কে বদলে নতুন রূপ দিতেন। তাঁর ভাস্কর্য ছিল ভিন্নমাত্রার। এক কথায় গভীর জীবনবোধের ভাস্কর ছিলেন তিনি।
২০১০ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘স্বাধীনতা পদক' অর্জন করেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। এছাড়াও পেয়েছেন-
- হিরো বাই দ্যা রিডার ডাইজেস্ট ম্যাগাজিন (ডিসেম্বর ২০০৪) - চাদেরনাথ পদক - অনন্য শীর্ষ পদক - রৌপ্য জয়ন্তী পুরস্কার (ওয়াইডব্লিউসিএ) - মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক মানবাধিকার পুরস্কার
২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০১৪ সালে একুশের বইমেলায় তাঁর আত্মজীবনী ‘নিন্দিত নন্দন' প্রকাশিত হয়।
সংগ্রামী এই নারী জীবন সায়াহ্নে এসে ভুগছিলেন কিডনি, ফুসফুসের রোগসহ কয়েকটি জটিল রোগে। ২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর বাসার বাথরুমে পড়ে গিয়ে গুরুতর আঘাত পান তিনি। এরপর থেকেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে তাঁর। গত বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ডয়চে ভেলে
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড