• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আজম খান ছাড়া গানের কথায় 'বাংলাদেশ' এভাবে আর কেউ বলেননি

  নাবিলা বুশরা

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:০৮
আজম খান
কিংবদন্তী শিল্পী আজম খান খুব সহজে জায়গা করে নিয়েছিলেন জনমানুষের মনে (ছবি: সংগৃহীত)

‘রেল লাইনের ঐ বস্তিতে জন্মেছিলো একটি ছেলে মা তাঁর কাঁদে ছেলেটি মরে গেছে হায়রে হায় বাংলাদেশ!’

১৯৭৪-৭৫ সালে আজম খানের গাওয়া এই গানটি বাংলাদেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। 'বাংলাদেশ' শব্দটি এতটা হতাশা নিয়ে স্বাধনীতা পরবর্তী সময়ে আর কোনও গানে বোধহয় উচ্চারিত হয়নি। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সংকট কাটিয়ে নতুন একটি জাতি গঠনের যে সংকুলতা সেটিই যেন এই গানে প্রকাশ পেয়েছে বারবার। মূলত স্বপ্নভঙ্গের এই গানের মধ্য দিয়েই আজম খানের উঠে আসা।

গানের কথায় এতটা মর্মস্পর্শী ছোঁয়া তখনই থাকে যখন নিজ থেকে এ কথাগুলো অনুভব করা হয়। আজম খান সেটি করতে পেরেছিলেন। ১৯৭২ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া এই কিংবদন্তী শিল্পী খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন মানুষের কষ্ট। পরিবার হারানোর কষ্ট, মায়ের চোখের সামনে সন্তানের মৃত্যু এসব কিছুই তিনি দেখেছেন সামনে থেকে। তাই তাঁর প্রতিটি গানই হৃদয় ছোঁয়া। আর এ জন্যই তাঁর গানের সহজ কথাগুলো পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যায় সহজে। তিনি গান গেয়েছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। গানের কথার সহজবোধ্যতার জন্যই আজও তাঁর শ্রোতাভক্তদের মন থেকে তিনি মুছে যাননি।

জন্ম এবং ব্যক্তিগত জীবন

১৯৫০ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন আজম খান। তাঁর পুরো নাম "মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান"। তাঁকে বাংলাদেশের পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের একজন অগ্রপথিক বা গুরু হিসেবে গণ্য করা হয়।

সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাবা আফতাবউদ্দিন আহমেদ এবং মা জোবেদা খাতুনের সাথে আজম খান বসবাস করতেন বাবার কমলাপুরের বাড়িতে। এখানেই বাবা, মা এবং চার ভাই ও এক বোনের সাথে বেড়ে ওঠেন তিনি।

১৯৫৬ সালে কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এর কিছুদিন পরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় আর লেখাপড়া করেননি তিনি।

১৯৮২ সালে সংসারী হন আজম খান। সহধর্মিনী সাহেদা বেগম মারা যাওয়ার পর থেকে একাকী জীবন বেছে নেন এই পপ সম্রাট। দুই মেয়ে এবং এক ছেলের জনক তিনি।

মুক্তিযুদ্ধে আজম খান

ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য থাকাকালীন ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের সময়ে আজম খান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। সে সময় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসঙ্গীত প্রচার করেন তিনি।

আজম খান

কিংবদন্তী শিল্পী আজম খান (ছবি: বিবিসি বাংলা)

১৯৭১ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা আফতাব উদ্দিন খানের অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আজম খান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি পায়ে হেঁটে আগরতলা যান। সে পথে তাঁর সঙ্গী ছিলেন তাঁর দুই বন্ধু। এ সময় তার লক্ষ্য ছিল সেক্টর ২ এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা।

প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগাতো তাঁর গান। তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের মেঘালয়ের শিবিরে। প্রশিক্ষণ শেষে কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেন তিনি।

কুমিল্লার সালদায় প্রথমবার সরাসরি যুদ্ধ করেন তিনি। এর কিছুদিন পর পুনরায় আগরতলায় ফিরে এসে ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইনচার্জের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। আর সে সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ। সেকশান কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন তিনি।

আজম খান তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১ এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এর আগে তাঁরা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংগঠিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন।

আজম খানের কর্মজীবনের শুরু প্রকৃতপক্ষে ৬০ দশকের শুরুতে হলেও ৭১ এর পর তাঁর ব্যান্ড উচ্চারণ এবং আখন্দ (লাকী আখন্দ এবং হ্যাপী আখন্দ) ভ্রাতৃদ্বয় দেশব্যাপী সঙ্গীতের জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেক ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে তৈরি করলেন অনুষ্ঠান। ১৯৭২ সালের দিকে সে অনুষ্ঠান বিটিভিতে প্রচার করা হল। ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ আর ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি সরাসরি প্রচার হলো বিটিভিতে। এ দুটো গান ব্যাপক প্রশংসা আর জনপ্রিয়তা পায় সে সময়।

এরপর দেশজুড়ে তাঁদের দল পরিচিতি পেয়ে যায়। ১৯৭৪-১৯৭৫ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘বাংলাদেশ’ (রেললাইনের ঐ বস্তিতে) শিরোনামের গান গেয়ে হইচই ফেলে দেন আজম খান। পাড়ার বন্ধু ফিরোজ সাঁইসহ ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ সবার সাথে গান করেন তিনি। এরই মধ্যে আরেক বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে প্রতিষ্ঠা করেন একটি এসিড-রক ঘরানার ব্যান্ড দল। ‘জীবনে কিছু পাবোনা এ হে হে! আজম খানের দাবী অনুসারে এটি বাংলা গানের ইতিহাসে- প্রথম হার্ডরক গান।

আজম খান শুধু কন্ঠশিল্পীই ছিলেন না

আজম খান যে শুধু কন্ঠশিল্পীই ছিলেন তা নয়। তাঁর পরিচিত এ চরিত্রের বাইরে তাঁকে দেখা গেছে ভিন্ন রূপেও। কখনো তিনি ছিলেন অভিনেতা, কখনো বা মডেল, কখনো তাঁকে দেখা গেছে ক্রিকেটার হিসেবে।

বিটিভির একাধিক নাটকে বাউল চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। শাহীন-সুমন পরিচালিত ‘গডফাদার’ নামের একটি ছবিতে নাম ভূমিকায় খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। পরবর্তীতে সুযোগ থাকলেও তিনি আর অভিনয়ে নাম লেখাননি। এনার্জি ড্রিংক এবং বাংলালিংকের দুটি বিজ্ঞাপন চিত্রে তাঁকে দেখা গেছে।

ক্রিকেটে আজম খানের রয়েছে অনন্য রেকর্ড। দেশের বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে ৪১ বছর বয়স থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত একটানা ১০ বছর ক্রিকেট খেলেছেন তিনি। ১৯৯১-২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে। ক্রিকেটে তিনি ছিলেন একজন অলরাউন্ডার।

স্বাধীনতার পরে আজম খানকেই বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীত বিকাশের পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরবর্তী বেশ কয়েকটি প্রজন্মের শিল্পীদের উপর তাঁর গভীর প্রভাব রয়েছে বলে বলেছিলেন কিংবদন্তী প্রয়াত বিখ্যাত ব্যান্ড শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু।

“আমার তো বটেই, আমার সমসাময়িক এবং আমার আগের একটি প্রজন্ম এবং আমার পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই এখনো আজম ভাই দ্বারা অনুপ্রাণিত। এখনো যাদের নিজের গান হয়নি, মঞ্চে তাদের এখনো আজম ভাই-এর গান গাইতে হয়। আর আমরাও আজম ভাই-এর গান দিয়েই ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম।”

সারাদেশে যে মানুষটিকে সবাই একনামে চিনত সেই মানুষটির পুরো জীবন ছিল খুবই সাদাসিধা। তাঁর এমন সাদামাটা জীবনধারা নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, “লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে দেখেছি উনাকে। আমাদের প্রতি তিনি সব সময় স্নেহপরায়ণ ছিলেন। তখন যদি আজম ভাই সালেকা-মালেকা না গাইতেন তবে এখনো হয়তো আমাদের ইংরেজি গানই গাইতে হতো। বাংলা গান আর গাওয়া হতো না।”

আলাল-দুলাল আর সালেকা-মালেকাদের মত সাধারণ মানুষদের নিয়ে গান গেয়েছেন বলেই মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিতে তাঁর বেশিদিন সময় লাগেনি। আর তাই তো তিনি এ দেশের মানুষের কাছে 'পপগুরু'।

২০১০ সাল থেকে মুখগহ্বরের ক্যান্সারে ভুগছিলেন ব্যান্ড গানের জগতের গুরু। দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১১ সালের ৫ জুন ঢাকাস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ক্যান্সারের কাছে হার মানেন তিনি।

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড