• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

টিনের চালে বৃষ্টির সেতার শোনার জন্য আপনি নেই! কোনো মানে হয়?

  মাহমুদুল হৃদয়

১৩ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

বাংলা সাহিত্যাকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম হুমায়ূন আহমেদ। ৭০ বছর আগে আজকের এই দিনে (১৩ নভেম্বর) জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।

১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি লেখা শুরু করেন "শঙ্খনীল কারাগার"। কিন্তু সাহিত্য জগতে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে "নন্দিত নরক" বইটির মাধ্যমে। ১৯৭২-এ কবি-সাহিত্যিক আহমদ ছফার উদ্যোগে উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স কর্তৃক গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত বাংলা ভাষাশাস্ত্র পণ্ডিত আহমদ শরীফ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে বাংলাদেশের সাহিত্যামোদী মহলে সাড়া পড়ে যায়। সেই থেকে তিনি মৃত্যু অবধি লিখে গেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক।

তিনি লিখে গেছেন বাদশাহ নামদার, মধ্যাহ্ন, মাতাল হাওয়া, দেয়াল এর মতো অসাধারণ উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর অন্যতম লেখা "জোছনা ও জননীর গল্প"। কোথাও কেউ নেই, মেঘ বলেছে যাব যাব, কবি, এইসব দিনরাত্রির মতো উপন্যাস লিখে তিনি শতশত পাঠককে কাঁদিয়েছেন। লিখেছেন ছোটদের জন্যে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়েও তিনি লিখেছেন। মধ্যবিত্ত জীবনের কথকথা তুলে ধরেছেন তাঁর অনেক অনেক লেখায়।

ফিকশন-এর লেখকও তিনি। জনপ্রিয় চরিত্র মিসির আলী ও হিমুর স্রষ্টা তিনি- যে দু’টি চরিত্র যথাক্রমে লজিক এবং এন্টি লজিক নিয়ে কাজ করে। মিসির আলি, হিমু, শুভ্র ছুঁয়ে দিয়েছে পাঠকের হৃদয়কে।

শুধু উপন্যাসের মধ্যে আটকে রাখেননি নিজেকে। লিখেছেন একাধিক নাটক। নাটক ও চলচ্চিত্রের পরিচালক হিসেবেও তিনি সমাদৃত।১৯৮৩ সালে টেলিভিশনের জন্যে তার প্রথম কাজ টেলিভিশন নাটক "প্রথম প্রহর" প্রচারিত হয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘অয়োময়ো’ বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে একটি অনন্য সংযোজন। যুদ্ধাপরাধীদের দাপটে দেশ কাপছে, তখন তিনি তাঁর নাটকে তোতা পাখির মুখ দিয়ে বলালেন, “তুই রাজাকার!”।

হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রথম ধারাবাহিক নাটক এইসব দিনরাত্রি (১৯৮৫) নাটকে লিউকোমিয়া আক্রান্ত শিশু চরিত্র 'টুনি'কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আহমেদের কাছে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের কাছে দর্শকের প্রচুর চিঠি আসে। হৃদয়কে কতটা ছুঁয়ে দিলে একটা চরিত্রের প্রতি এতটা ভালোবাসা আসে! নাগরিক ধারাবাহিক "কোথাও কেউ নেই"এর একটি চরিত্র বাকের ভাই। নাটকের শেষদিকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির রায় হলে ঢাকার রাজপথে বাকের ভাইয়ের মুক্তির দাবীতে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতে দর্শক 'বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে' স্লোগান দিয়ে মিছিল করে। এমনকি, হুমায়ূন আহমেদের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে দর্শকেরা আক্রমণ করে। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে তিনি রমনা থানায় জিডিও করেছিলেন। একটা চরিত্রকে কতটা বাস্তবই না করে তুলেছিলেন।

হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটকগুলো যখন প্রচারিত হতো, তখন গ্রামের রাস্তাঘাটে লোকজন থাকতো না। যাদের বাড়িতে টেলিভিশন ছিল, তাদের উঠানে লোক ভরে যেত নাটক দেখার জন্যে। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে হাট-বাজার, সবখানে নাটকের সেই পর্বগুলো নিয়ে আলোচনা চলতো সপ্তাহব্যাপী।

তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি দেখতে সিনেমাহলে দর্শকের ঢল নেমেছিল। মাসের পর মাস ধরে এই চলচ্চিত্রটি বক্স অফিস দখল করে রেখেছিল। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল এই ছবিটি। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র ‘শ্যামল ছায়া’ বিদেশী ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। ১৯৯৯ এ তিনি নির্মাণ করেন 'শ্রাবণ মেঘের দিন'। ছবিটি সাতটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এছাড়াও তিনি দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথাসহ বেশ কিছু সিনেমা নির্মাণ করেছেন। ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২) তাঁর পরিচালিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র। মারা যাওয়ার পূর্বে তিনি এই চলচ্চিত্র নিয়েই শেষ কথা বলেছিলেন মাজহারুল ইসলামের সাথে।

২০১১-এর সেপ্টেম্বের মাসে সিঙ্গাপুরে ডাক্তারী চিকিৎসার সময় তাঁর দেহে মলাশয়ের ক্যান্সার(স্টেজ-ফোর) ধরা পড়ে।স্টেজ ফোর ক্যান্সার মানে সবচেয়ে পরিণত ক্যান্সার। স্টেজ ফোর এ ক্যান্সার কোষগুলো মূল জায়গা ছাড়াও শরীরের অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। কোলন ক্যান্সারে চার নম্বর স্টেজ থেকে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা খুবই কমশতকরা ৭% এর মতো! কেমো নেয়া সত্ত্বেও তেমন কোনো অগ্রগতি হচ্ছিল না। হুমায়ূন আহমেদ, তাঁর মনের জোরে ১২টি কেমো পার করেন।

চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও লেখালেখি ছাড়েননি। ওনার শেষ উপন্যাসটি 'দেয়াল' এর অল্প কয়টি পর্ব অন্যদিন পত্রিকায় ধারাবাহিক লিখেছিলেন। সেসময় তার লেখা কলাম 'নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ' ছাপা হতো় বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক। তিনি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থভাবে ফিরে যেতে পারবেন।

১২ই জুন, সকাল ৬টায় তাঁর একটি সার্জারি হয়। সফল এই সার্জারির পর জানা যায় তার শরীরে আর কোনো ক্যান্সার কোষ নেই। কুইন্সে ভাড়া করা একটি দোতলা বাড়িতে ফিরে যান লেখক। কিন্তু অপারেশন সফল হলেও শারীরিক অস্বস্তি কমছিল না মোটেই। পেটে ব্যথা ও অস্বস্তি হচ্ছিল। একপর্যায়ে পেটব্যথা অনেক বাড়লে তাঁকে আবার হাসপাতালে নিতে হয়। সেখানে চিকিৎসা চলছিল তাঁর। কিন্তু দিনদিন শরীরের নানা জটিলতা তাঁকে ক্রমান্বয়ে দুর্বল করে তুলছিল।

তাঁর শারীরিক অবস্থাও দিনদিন খারাপ হতে থাকে। অবশেষে ১৯ জুলাই হুমায়ূন আহমেদ মারা যান।

সারাদেশ স্তব্ধ হয়ে যায় হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর শুনে। দুইদিন পর তার মরদেহ দেশে আনা হয়। হাজার-হাজার ভক্ত ছুটে গেছিলেন শহীদ মিনারে প্রিয় লেখকের মরদেহের কাছে। কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে আর কেউ নড়তে চায়না। কাঁদতে কাঁদতে লেখককে শেষ বিদায় জানায় তাঁর ভক্তরা। একটা মানুষের জন্য এত চোখের পানি কেউ দেখেনি আগে। তাঁকে গাজীপুরে তাঁর প্রিয় স্থান। 'নুহাশ পল্লী'তে দাফন করা হয়।

হুমায়ুন স্যার, আপনি বুঝতে পারেন আপনার প্রস্থান বাংলা সাহিত্যে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করেছে? আপনার নতুন লেখা বই আর আসে না বইমেলায়! কত শূন্যতা!

পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসে। শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজে। সেই অপূর্ব সংগীত শোনার জন্য আপনি নেই! সত্যি? কোনো মানে হয়?

শিক্ষার্থী, খুলনা পাবলিক কলেজ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড