যুলকারনাইন আহমেদ
মানবশরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নাম খুব সম্ভবত মস্তিষ্ক। মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান অঙ্গ তো বটেই পুরো মানবদেহেরই কেন্দ্রীয় কমান্ড সিস্টেম দেড় কেজি ওজনের একটি মস্তিষ্ক। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য প্রাণীকূলের অন্য যে কোনো প্রাণীর তুলনায় মানব মস্তিষ্কের আয়তন সবচেয়ে বেশি। যদিও অন্য যে কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর মত মানুষের মস্তিষ্কেরও বেশ কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য কমবেশি একই।
মানব মস্তিষ্কের সাধারণ কিছু দিক
১. যে কোনো মেরুদণ্ডী প্রাণীর তুলনায় আয়তনে মানব মস্তিষ্কের আয়তন সবচেয়ে বেশি
২. এর ভর ১.৫ কেজি (৩.৩ পাউন্ড)
৩. একজন পুরুষের মস্তিষ্কের গড় আয়তন ১২৭৪ কিউবিক সেন্টিমিটার
৪. একটি নারী মস্তিষ্কের গড় আয়তন ১১৩১ কিউবিক সেন্টিমিটার
৫. মস্তিষ্ক সাধারণ মানবদেহের মাত্র ২ শতাংশ জায়গা দখল করে
৬. মস্তিষ্কের সেরেব্রাম অংশ পুরো মস্তিষ্কের ৮৫ শতাংশ জায়গা দখল করে
৭. মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটারে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন স্নায়ুকোষ অবস্থান করে
৮. মস্তিষ্কের হোয়াইট ম্যাটারে প্রায় এক বিলিয়ন স্নায়ুতন্তুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়
৯. পুরো মস্তিষ্কে প্রায় এক ট্রিলিয়ন সিন্যাপসিস স্নায়ুকোষের সংযোগ উপাদান হিসেবে কাজ করে
সাধারণ গঠনপ্রণালী
মানব মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ সেরেব্রাম। সেরেব্রামকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ব্রেইনস্টিমের নিচের অংশে থাকে সেরেবেলাম। সেরেব্রামের উপরিভাগ চারটি লোবে বিভক্ত। ফ্রন্টাল, প্যারাইটাল, টেম্পোরাল এবং অক্সিপিটাল।
অন্যসব মেরুদণ্ডী প্রানীর মতই মানুষের মস্তিষ্কও ৩ টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। অগ্রমস্তিষ্ক, মধ্যমস্তিষ্ক এবং পশ্চাৎমস্তিষ্ক।
পুরো মস্তিষ্ক ভেন্ট্রিকল নামক ফ্লুইড জাতীয় পদার্থে সংরক্ষিত থাকে। অগ্রমস্তিষ্ক পরিণত বয়সে সেরেব্রাম, মধ্যমস্তিষ্ক ব্রেইনস্টেম এবং পশ্চাৎমস্তিষ্ক ব্রেইনস্টেম এবং সেরেবেলাম গঠন করে।
মানব মস্তিষ্কের কন্ট্রোল ইউনিট বলা চলে সেরেব্রাল কর্টেক্সকে। এটি যাবতীয় জটিল চিন্তাভাবনা এবং কাজের সমন্বয় করে থাকে। আমাদের মাথার পিছনদিকে অক্সিপিটাল লোবে আমাদের দর্শন কাজের সকল প্রক্রিয়া সংগঠিত হয়। টেম্পোরাল লোবে শ্রবণ এবং বাকশক্তি নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়া হিপ্পোকম্পাস ও এমিগডালা যা স্মৃতি এবং আবেগের নিয়ন্ত্রক, সেই অংশের কাজটিও সম্পন্ন হয় টেম্পোরাল লোবে।
এছাড়া প্যারাইটাল লোব দূরত্ব বিন্যাস এবং দিক নির্ধারণ বা ন্যাভিগেশন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
ব্রেইনস্টেম অংশটি ৩ টি আলাদা অংশ নিয়ে গঠিত। মেডুলা অবলাংগাটা, পনস এবং মধ্যমস্তিষ্ক। ব্রেইনস্টেম সরাসরি স্পাইনাল কর্ডের সাথে যুক্ত এবং এটি মস্তিষ্কের সাথে সারা দেহের সংযোগের কাজটি করে থাকে। এছাড়া মানবশরীরের জটিল কিছু কার্যক্রম যেমন হৃদপিন্ড, শ্বাস প্রশ্বাস কিংবা চিন্তাচেতনার দিকটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
সেরেব্রাম এবং ব্রেইনস্টেমের মধ্যবর্তী অংশে থ্যালামাস এবং হাইপোথ্যালামাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। থ্যালামাস ঘুম, চেতনা এবং সতর্কীকরণ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে হাইপোথ্যালামাস পিটুইটারি গ্রন্থির সাহায্যে দেহের অভ্যন্তরীণ সকল কাজের সমন্বয় সাধনে সাহায্য করে।
মানব মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য প্রাণী মস্তিষ্ক
মস্তিষ্কের আকার বড় হলেই প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা উন্নত হবে এমনটি ভাবা অযৌক্তিক। তুলনামূলক হিসেবে একেকটি শুক্রাণুর মস্তিষ্ক পূর্ণাঙ্গ মানব মস্তিষ্ক অপেক্ষা ৫ গুণ বেশি ভারী। তবে সমগ্র দেহের আয়তন এবং মস্তিষ্কের আয়তনের অনুপাতের উপর ভিত্তি করে যে কোনো প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা একটি তুলনামূলক আভাস পাওয়া যায় বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা পোষণ করেন।
সাধারণ মানুষের ব্যাপারেও এটি সত্য বলে বিবেচ্য। কারো মস্তিষ্কের আয়তন কখনোই সেই মানুষের বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ করে না। অনেক বিশেষজ্ঞদের মাঝে গড়ের তুলনায় কম আয়তনের মস্তিষ্কের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন রাশিয়ান কবি ইভান তুর্গেনেভের মস্তিষ্কের আয়তন ২০২১ গ্রাম হলেও ফরাসি কবি এনাটল ফ্রান্সের ক্ষেত্রে তা ছিল মাত্র ১০১৭ গ্রাম।
মাত্র ২ শতাংশ জায়গা দখল করলেও মানুষের দেহ এবং মস্তিষ্কের অনুপাত বেশি ভারী বলেই ধরে নেন বিজ্ঞানীরা। ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের অধ্যাপক ড. হল্যান্ড এর মতে, মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর বুদ্ধিমত্তার মূল পার্থক্য লুকিয়ে আছে মানুষের নিউরনে।
প্রতি একক আয়তনে মানুষের নিউরন সংখ্যা অন্য যেকোন প্রাণী মস্তিষ্কের তুলনায় অনেক বেশি। আর এটি সম্ভব হয়েছে অসমান এই মস্তিষ্কে প্রচুর পরিমাণ উঁচু নিচু খাঁজ থাকার কল্যাণে।
ড. হল্যান্ড আরো বলেন, অন্য যে কোনো প্রাণীর তুলনায় মানুষের ফ্রন্টাল লোব অনেক বেশি বড়। এবং এটি অন্য যেকোন প্রাণীর তুলনায় এটি উচ্চস্তরের কার্যক্রম সম্পাদনে সক্ষম। দক্ষতা, পরিকল্পনা এবং যুক্তির এই জটিল সমন্বয়ের কারণেই মূলত মাত্র ১.৫ কেজির মস্তিষ্ক মানুষকে পুরো পৃথিবীর নিয়ন্ত্রকের আসনে বসিয়েছে।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড