• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বীরাঙ্গনাদের সংগ্রামী জীবনের গল্প শোনানো নারী নীলিমা ইব্রাহিম

  অধিকার ডেস্ক    ১১ অক্টোবর ২০১৮, ০৯:৩১

অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম
অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম (ছবি: সংগৃহীত)

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বরাবর কষ্টের ও বেদনার। সে সময়ের মা-বোনদের প্রতি পাকিস্তানীদের বর্বরতার কথা শুনলে আজও অন্তরে জমে থাকা কষ্টটা যেন কথা বলে ওঠে। পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এই দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামধারী খুনিদের বর্বর নির্যাতনের ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছেন আমাদের অগণিত মা-বোন। এত অত্যাচার সহ্যের পর তাদের পাওনা ছিল একটা সুস্থ সমাজের যা তারা পাননি। বরং এই রক্ষণশীল সমাজে নিগৃহীত হয়েছেন নানাভাবে। এদের মাঝে কেউ কেউ ‘ভাগ্যবতী’ ছিলেন যারা পরিবারের সাথে থাকতে পেরেছেন, তাদের ভালোবাসায় স্বাভাবিক হয়েছেন। এদেরকে আমরা চিনি ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে।

সাহসিকতার সাথে এই বীরাঙ্গনাদের কঠিন সময়ের সাক্ষাৎকার নিয়েই কাজ করেছিলেন একজন নারী। এদের কথা নিয়ে রচিত হয় কালজয়ী প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’। আর এ বইটির রচয়িতা ড. নীলিমা ইব্রাহিম। গ্রন্থটিতে প্রকাশ পেয়েছে বীরাঙ্গনাদের ওপর ঘটে যাওয়া নারকীয় বর্বরতার বাস্তব কাহিনী। বইটির ভূমিকাতে ড. নীলিমা লিখেছিলেন - "চরিত্রগুলি ও তাঁদের মন-মানসিকতা, নিপীড়ন, নির্যাতন সবই বস্তুনিষ্ঠ"।

মেয়েদের মাঝে শিক্ষার আলো জাগানিয়া নারী বেগম রোকেয়ার আলোকিত পথের পথিক নীলিমা ইব্রাহিম শিক্ষার আলো জ্বালানোর কাজ করেছেন একই সাথে নারী-পুরুষ সবার জন্য। বিশেষ অবদান রেখেছেন বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া নারীদের শিক্ষিত ও স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে।

নীলিমা ইব্রাহিমের কর্মজীবন:

কর্মজীবনের শুরুতে নীলিমা ইব্রাহিম কলকাতার লরেটো হাউসে লেকচারার (১৯৪৩-৪৪) হিসেবে চাকরি করেন। তারপর দু’বছর (১৯৪৪-৪৫) তিনি ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনের লেকচারার ছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৭২ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ১৯৭৪-৭৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমির অবৈতনিক মহাপরিচালক ছিলেন।

তিনি বিধ্বস্ত বাংলা বিভাগকে পুনরুজ্জীবিত করেন। সেই সঙ্গে রোকেয়া হলের প্রভোস্ট এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন। আরও দুটি স্পর্শকাতর বিষয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি পালন করেন।

তা হলো- একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের দালাল রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি কর্তৃক অপহৃত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিতা হতভাগা অসংখ্য বাঙালি মা-বোন এবং ‘ওয়ার বেবিদের’ পুনর্বাসনের জটিল কাজে হাত দেন।

নীলিমা লেখক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার লেখা, ভাষ্য এবং চিন্তা ঘিরে অনেক সময় বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু কখনোই তিনি তার চিন্তার সঙ্গে আপস করেননি, প্রয়োজনে আদালতে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আইনি লড়াইয়ে জিতে মাথা উঁচু করে আবারও বেরিয়ে এসেছেন খোলা আলো-হাওয়ায়।

নীলিমা ইব্রাহিম বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজকল্যাণ ও নারী-উন্নয়সংস্থা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনের সঙ্গে যু্ক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতি ও বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির জীবন সদস্য ছিলেন।

এছাড়া বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী এবং কনসার্নড উইমেন ফর ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর বোর্ড অব গবর্নরসের চেয়ারপার্সন হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ইন্টারন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব উইমেন-এর সভানেত্রী এবং অ্যাসোসিয়েটেড কান্ট্রি উইমেন অব দি ওয়ার্লাল্ড-এর সাউথ ও সেন্ট্রাল এশিয়ার এরিয়া প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি বার্লিন, মিউনিক ও ফ্রাংফুর্টে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক বিশ্বসমবায় সম্মেলন’-এ পূর্বপাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৭৩-এ নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক ওয়ান এশীয় সম্মেলন’-এ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৪-এ তিনি মস্কোয় অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বশান্তি কংগ্রেস’, হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বনারী বর্ষ’ এবং ১৯৭৫-এ মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বনারী সম্মেলন’-এ যোগ দেন।

নীলিমা ইব্রাহিমের রচনাসমগ্র:

নীলিমা ইব্রাহিম বেশকিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার গ্রন্থবদ্ধ রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: গবেষণা শরৎ-প্রতিভা (১৯৬০), বাংলার কবি মধুসূদন (১৯৬১), ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী সমাজ ও বাংলা নাটক (১৯৬৪), বাংলা নাটক : উৎস ও ধারা (১৯৭২), বেগম রোকেয়া (১৯৭৪), বাঙ্গালীমানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৮৭), সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ (১৯৯১); ছোটগল্প রমনা পার্কে (১৯৬৪); উপন্যাস বিশ শতকের মেয়ে (১৯৫৮), এক পথ দুই বাঁক (১৯৫৮), কেয়াবন সঞ্চারিণী (১৯৬২), বহ্নিবলয় (১৯৮৫); নাটক দুয়ে দুয়ে চার (১৯৬৪), যে অরণ্যে আলো নেই (১৯৭৪), রোদ জ্বলা বিকেল (১৯৭৪), সূর্যাস্তের পর (১৯৭৪); কথানাট্য আমি বীরাঙ্গনা বলছি (২ খন্ড ১৯৯৬-৯৭); অনুবাদ এলিনর রুজভেল্ট (১৯৫৫), কথাশিল্পী জেমস ফেনিমোর কুপার (১৯৬৮), বস্টনের পথে (১৯৬৯); ভ্রমণকাহিনী শাহী এলাকার পথে পথে (১৯৬৩); আত্মজীবনী বিন্দু-বিসর্গ (১৯৯১) ইত্যাদি।

অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিমের "আমি বীরাঙ্গনা বলছি" বইটার একটা ছোট অংশ -

''হঠাৎ অনেক লোকের আনাগোনা,চেঁচামেচি কানে এলো। একজন বাংকারের মুখে উঁকি দিয়ে চিৎকার করলো, কই হ্যায়: ইধার আও। মনে হলো আমরা সব এক সঙ্গে কেঁদে উঠলাম। ঐ ভাষাটা আমাদের নতুন করে আতঙ্কগ্রস্ত করলো। কয়েকজনের মিলিত কন্ঠ এবারে, মা, আপনারা বাইরে আসুন । বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা আপনাদের নিতে এসেছি। চিরকালের সাহসী আমি উঠলাম। কিন্তু এতো লোকের সামনে আমি সম্পূর্ণ বিবস্ত্র, উলঙ্গ। দৌড়ে আবার বাংকারে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যে বলিষ্ঠ কণ্ঠ প্রথম আওয়াজ দিয়েছিলো, কোই হ্যায়, সেই বিশাল পুরুষ আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে নিজের মাথার পাগড়িটা খুলে আমাকে যতটুকু সম্ভব আবৃত করলেন। . . . . . . . . . আমি ওই অধিনায়ককে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম।''

জন্ম ও শিক্ষা

বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামের এক জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রফুল্লকুমার রায়চৌধুরী এবং মাতা কুসুমকুমারী দেবী।

নীলিমা ইব্রাহিম বরাবরই একজন মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি খুলনা করোনেশন বালিকা বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা (১৯৩৫), কলকাতা ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন থেকে আইএ (১৯৩৭) এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএবিটি (১৯৩৯) পাস করেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা বিষয়ে এম.এ (১৯৪৩) পাস করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম ‘বিহারীলাল মিত্র গবেষণা’ বৃত্তি লাভ করেন। একই বছর তিনি ইন্ডিয়ান আর্মি মেডিকেল কোরের ক্যাপ্টেন ডাক্তার মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ঢাকায় স্থায়িভাবে বসবাস করতে থাকেন। দীর্ঘকাল পরে ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক’। একই বছর তিনি ঢাকার আলিয়াঁসে ফ্রাঁসেস থেকে ইন্টারমিডিয়েট ইন ফ্রেন্স-এ ডিপ্লোমা লাভ করেন।

পুরস্কার

বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯)

জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭৩)

মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার (১৯৮৭)

লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৯)

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্মৃতি পদক (১৯৯০)

অনন্য সাহিত্য পদক (১৯৯৬)

বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬)

বঙ্গবন্ধু পুরস্কার (১৯৯৭)

শেরে বাংলা পুরস্কার (১৯৯৭)

থিয়েটার সম্মাননা পদক (১৯৯৮)

একুশে পদক (২০০০)

মৃত্যু

অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম ২০০২ সালের ১৮ই জুন মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড