• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

তুরস্কের সৌদি দূতাবাস থেকে নিখোঁজ সাংবাদিক হত্যা রহস্য

দেশ দুটির মধ্যে স্বরণকালের সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক হতে পারে

  এস এম সোহাগ

০৮ অক্টোবর ২০১৮, ২১:৫৮
সৌদি সাংবাদিক হত্যা
ছবি : সম্পাদিত

সৌদি সমালোচক জামাল খাসোগি হত্যার তদন্তের জন্য ইস্তাম্বুলের সৌদি দূতাবাসে প্রবেশ ও অনুসন্ধানে সহযোগিতার অনুরোধ করেছে তুর্কি প্রশাসন। সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী জামাল খাসোগির রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া নিয়ে পাশ্চাত্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের গণমাধ্যমে তোলপাড় চলছে যা এখন পুরোদস্তুর হত্যা রহস্যের চেহারা নিয়েছে। ‘আল-জাজিরা’

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে দোসরা অক্টোবর দুপুরে বান্ধবীকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে সৌদি কনস্যুলেটে ঢুকেছিলেন দেশটির যুবরাজের সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাসোগি। উদ্দেশ্য ছিল তার বিবাহ-বিচ্ছেদের সার্টিফিকেট নেয়া। তার পর থেকেই জামাল খাসোগি নিখোঁজ হন। ছয় দিন পর তুরস্কের পুলিশ অভিযোগ তোলে যে, তাকে হয়তো কনস্যুলেটের ভেতরেই খুন করা হয়েছে।

এদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোইয়ান বলেছেন, সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি নিখোঁজের বিষয়টি কঠোর নজরদারিতে রাখছে তুরস্ক। এর আগে তুরস্ক কর্র্তৃপক্ষ জানায়, তারা মনে করে খাসোগিকে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে।

রবিবার ( ৭ অক্টোবর ) এরদোয়ান সাংবাদিকদের জানান, গত সপ্তাহে নিখোঁজ হওয়া সৌদি সাংবাদিকের মামলাটি তদন্ত করতে, ভিডিও ক্যামেরা ফুটেজ নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। দূতাবাস বলেছে সন্দেহভাজন সময়ের ফুটেজ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পাওয়া যাচ্ছেনা।এছাড়া, বিমানবন্দরের রেকর্ডও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, খাসোগি একজন সৌদি নাগরিক এবং তার কি হয়েছে তা জানতে তিনি খুবই আগ্রহী, তারা তুর্কী সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। আমি যা বুঝতে পারছি তা হলো- তিনি (খাসোগি) কনস্যুলেটে ঢুকে আবার কয়েক মিনিট বা ঘণ্টাখানেক পরই বেরিযে যান, তবে আমি নিশ্চিত নই। আমরা তদন্ত করছি।

ছবি : নিউ ইয়র্ক টাইমস

তিনি আরও বলেন, কনস্যুলেট ভবন সৌদি আরবের নিজ ভূখন্ডের মর্যাদা ভোগ করে। কিন্তু তদন্তকারীরা ভেতরে ঢুকতে চাইলে অনুমতি দেয়া হবে এবং তাদের কোনো কিছু লুকানোর নেই। সৌদি আরবে খাসোগির নামে মামলা আছে কি না জানতে চাইলে যুবরাজ সালমান বলেন, তিনি কোথায় আছেন সেটাই তারা প্রথম জানতে চান। ‘বিবিসি বাংলা’

তিনি আরও বলেন, ‘সৌদি কনস্যুলেটের প্রবেশ ও প্রস্থানের তালিকা, বিমানবন্দরে বহির্গমন-নির্গমন এবং যাবতীয় ভিডিও ক্যামেরা রেকর্ড অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে তদন্তকারীদল। তবে, আমি এখনও বিষয়টিতে ইতিবাচক খবরের আশা পোষণ করি।’

খাসোগির সঙ্গে হাতিস চেঙ্গিজ নামে একজন তুর্কি মহিলার প্রণয় চলছিল। হাতিসকে নিয়েই তিনি দোসরা অক্টোবর ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেট ভবনে এসেছিলেন। চেঙ্গিজ বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন এবং খাসোগি কনস্যুলেটের ভেতরে যান। কিন্তু খাসোগি আর বেরিয়ে আসেননি।

রবিবার তুরস্কের উপরাষ্ট্রমন্ত্রী সেদাত ওনাল খাসোগির অন্তর্ধানের পর থেকে দ্বিতীয়বার তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তুরস্কে সৌদি রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠায় বলে মন্ত্রণালয় সূত্র ‘আল-জাজিরা’কে জানায়।

ওনল রাষ্ট্রদূতকে বলেছেন যে, তুরস্ক আশা করছে তদন্ত প্রক্রিয়ার সময় সৌদি আরব সম্পূর্ণ সহযোগিতা পাবে।

সোমবার তুরস্ক ফরেনসিক অনুসন্ধানের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পূর্ণ দূতাবাস প্রাঙ্গণে প্রবেশাধিকারের অনুরোধ জানায়।

তুর্কি ভূখন্ডে সাংবাদিক খাসোগি হত্যার বিষয়ে যদি সৌদি আরবের সংশ্লিষ্টতা থাকে তাহলে দেশ দুটির মধ্যে স্বরণকালের সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক হতে পারে। কাতার,ইরান ও ইয়েমেন ইস্যুতে এমনিতেই তাদের মধ্যকার সম্পর্ক অবনতি হচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।

সৌদি আরবের সমালোচনা :

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের অন্যতম প্রধান সমালোচক হচ্ছেন এই ৫৯ বছর বয়স্ক জামাল খাসোগি। তিনি আল-ওয়াতান পত্রিকা ও সৌদি টিভির সাবেক সম্পাদক ছিলেন। তিনি সৌদি রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং উর্ধ্বতন সৌদি কর্মকর্তাদের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছিলেন। কিন্তু কয়েকজন বন্ধুকে গ্রেফতার করার পর আল-হায়াত পত্রিকায় তার কলামটি বন্ধ করে দেয়া হয় এবং টুইট করা বন্ধ করতে সতর্ক করে দেয়া হয়।

খাসোগির বান্ধবী হাতিস চেঙ্গিজ। ছবি : বিবিসি নিউজ

এর পর খাসোগি সৌদি আরব ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং সেখানে প্রভাবশালী ‘দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর ও ‘আরব নিউজের’ সাবেক প্রধান সম্পাদক খাগোসি সৌদি যুবরাজ সালমানের কট্টর সমালোচক ছিলেন। তার নিখোঁজ হবার ঘটনায় মার্কিন দৈনিক অভিযোগ করেছে, ‘খাসোগিকে হত্যা করতে ১৫ জনের একটি বিশেষ দল পাঠানো হয়েছিল।’

চলতি বছরের শুরুর দিকে ‘আল-জাজিরার’ আপ-ফ্রণ্টের এক ভাষণে খাসোগি বলেছিলেন, সৌদি আরবে পলিসির সমালোচনা করলে বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের আটক করে কারাগারে রাখা হয়েছে।

‘আজ আমরা যখন এসব নিয়ে কথা বলছি ঠিক তখনই সৌদি বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা জেল খাটছেন। এখন, কেউই (যুবরাজ কর্তৃক শুরু হওয়া সংস্কারের) সালমানের বিরুদ্ধে কথা বলার ও সমালোচনা করার সাহস পাবে না’। তিনি আরও বলেন, ‘এটা তার জন্য আরও ভালো হবে যদি তিনি সৌদি বুদ্ধিজীবী, সৌদি লেখক, সৌদি প্রচার মাধ্যমকে বিতর্কের জন্য সমালোচকদের শ্বাস প্রশ্বাসের অনুমতি দেন।’।

সৌদি আরব কি কখনও সালমানের অধীনে গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারে কিনা তা জানতে চাওয়া হলে খাসোগি বলেন, ‘এটা তার আওতাধীন না। দেশিটিতে গণতন্ত্রের জন্য ও ক্ষমতা ভাগাভাগি করা নিয়ে তার সামান্যতম প্রচেষ্টার কথাও আমি শুনিনি।’

‘ওয়াশিংটন পোস্টের’ জন্য তার লেখাগুলিতে, সৌদি এই সমালোচক কাতার ও কানাডা, ইয়েমেনের যুদ্ধ, এবং রাজ্যে মতবিরোধ ও গণমাধ্যমগুলির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করে সৌদি নীতিমালা অবলম্বনকে চপেটাঘাত করেছিলেন।

খাসোগিকে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে কনস্যুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে; প্রাথমিকভাবে এমন অনুমান করছে তুরস্কের পুলিশ। শুধু তাই নয়, শনিবার দুই অজ্ঞাতনামা সূত্রের বরাত দিয়ে তুর্কী সংবাদমাধ্যম ও ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, খাসোগির মৃতদেহ কনস্যুলেট থেকে বের করেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ‘আনাদোলু’ জানিয়েছে, যে সময়ে খাসোগি কনস্যুলেটের ভেতরে ছিলেন; সেই সময় প্রায় ১৫ সৌদি নাগরিক সেখানে ছিল। মঙ্গলবারই এই ১৫ জন বিমানে ইস্তাম্বুল পৌঁছায়।

তুর্কি-আরব মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান তুরান কিসলাকচি মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, তুর্কি পুলিশ সৌদি কনস্যুলেটের নিরাপত্তার জন্য বসানো সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করেছে এবং তাতে জামাল খাসোগি বেরিয়ে যাচ্ছেন এমন কোন কিছু দেখা যায়নি।

কিন্তু এ সময়ই কিছু কূটনৈতিক গাড়ি কনস্যুলেটে ঢুকতে এবং বের হতে দেখা গেছে। খাসোগির অন্তর্ধান রহস্যের তদন্ত শুরু করেছেন তুরস্কের কর্মকর্তারা। একটি নিরাপত্তা দল ইতোমধ্যে ইস্তাম্বুল এসেছে।

২০১১ সালে সালে ইয়েমেনের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সৌদি লেখক জামাল খাসোগির ছবি হাতে তওয়াক্কল কারমান। ছবি : এপি

কিন্তু তাকে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যা করার কোন প্রমাণ বা কিভাবে তাকে খুন করা হলো, এ ব্যাপারেও কোনো তথ্য দেননি তুর্কি কর্মকর্তারা। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ‘ব্লুমবার্গ’ নিউজকে বলেন, তুর্কি কর্তৃপক্ষ কনস্যুলেট ভবন তল্লাশি করতে পারে, এতে কোনো বাঁধা নেই।

খাসোগির কনস্যুলেটে আসার উদ্দেশ্য ছিল, তার পূর্বতন স্ত্রীকে যে তিনি ডিভোর্স (তালাক) দিয়েছেন এই মর্মে একটি প্রত্যয়নপত্র নেয়া, যাতে তিনি হাতিসকে বিয়ে করতে পারেন। খাসোগি তার মোবাইল ফোনটি হাতিসের হাতে দিয়ে ভবনের ভেতরে ঢোকেন।

হাতিস সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, খাসোগি এ সময় বিমর্ষ এবং মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন। কারণ তাকে ওই ভবনে ঢুকতে হচ্ছে। জামাল খাসোগি তাকে বলেছিলেন যদি তিনি কনস্যুলেট থেকে বের না হন। তাহলে তিনি যেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের একজন উপদেষ্টাকে ফোন করেন।

খাসোগির বান্ধবী দূতাবাসটির বাইরে অপেক্ষা করেন মঙ্গলবার স্থানীয় সময় দুপুর একটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু তিনি জামাল খাসোগিকে কনস্যুলেট থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেননি। বুধবার সকালে কনস্যুলেট খোলার সময় তিনি আবার সেখানে উপস্থিত হন। তখন পর্যন্ত খাসোগির কোন খোঁজ তো মেলেইনি, এখনো তিনি নিরুদ্দেশ।

‘তুরস্ক ও সৌদি আরবের সম্পর্ক এখন তিক্ত অবস্থায় আছে এবং একজন সুপরিচিত সৌদি ভিন্নমতাবলম্বীকে তুরস্কের মাটিতে রাষ্ট্রীয় মদদে হত্যার ব্যাপারটি প্রমাণিত হলে তা আরও বিরূপ হবে’ বলে ‘বিবিসি নিউজের’ সংবাদদাতা বলছেন।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই সৌদি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এ ঘটনা সম্পর্কে ব্যাখ্যা চেয়েছে। তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে পার্টিও বলেছে, খাসোগির কি হয়েছে তা ব্যাপক তদন্তের মাধ্যমে বের করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড