রেহেনা আক্তার রেখা
‘আমি চেয়ে আছি তোদের পানে রে ওরে ও শিশুর দল, নতুন সূর্য আসিছে কোথায় বিদারিয়া নভোতল।’
এভাবেই শিশুদের প্রতি নিজের অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুর প্রতি নজরুলের এই বিশ্বাস হয়তো আমাদের অনেকের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে। তবে পার্থক্য এইটুকু নজরুলের মতো শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা ততটা সচেতন নয়। বিশেষ করে আমাদের আশেপাশে বেড়ে ওঠা পথশিশুদের ব্যাপারে।
আগামী প্রজন্মের বিরাট একটি অংশজুড়ে রয়েছে পথশিশুরা। পথে পথে বেড়ে ওঠা শিশুদের বলা হয় পথশিশু। শুধু পথশিশু নয়, তারা আমাদের কাছে ‘টোকাই’, ‘পথকলি’, ‘ছিন্নমূল’ বলেও পরিচিত।
অভাবে জর্জরিত পথশিশুদের অনেকে জড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগত। রাজধানীতে সন্ত্রাস জন্ম হওয়ার বড় একটি কারণ পথশিশুরা।তাদের অনেকে অভাব অনটনে বাধ্য হয়ে বেছে নিচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আর কিছু সুবিধাভোগী তাদেরকে অন্ধকার জগতের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
এইসব শিশুদের ঠিকানা নৌ অথবা বাস টার্মিনাল, খোলা আকাশের নিচে, রেলস্টেশন, সেতুর নিচে, মার্কেট, পার্কসহ বিভিন্ন জায়গা। ছিন্নমূল শিশুরা রাত-দিন পরিশ্রম করে সর্বোচ্চ আয় করে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এ টাকা দিয়েই তারা জীবিকা নির্বাহ করে। অনেক সময় সারা দিনে তাদের কোনো আয় হয় না, সেদিন তাদের না খেয়ে দিন পার করতে হয়। যার কারণে তারা চর্মরোগ, ডায়রিয়া, জন্ডিস ঠাণ্ডা জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়।
অধিকাংশ শিশু অসুস্থ অবস্থায় বঞ্চিত হয় চিকিৎসা থেকে।
গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশের ১০ লাখেরও বেশি পথশিশু স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। বিবিএস এর তথ্যমতে, শিশুরা বড়দের মতো কাজ করে ৮৫ শতাংশ, স্কুলে যায় না ২৪ লাখ শিশু, মজুরি পায় না ১৬ লাখ শিশু, পরিবারকে সহায়তা দিতে কাজ করে ৩০ শতাংশ শিশু, কৃষি ও কল-কারখানায় কাজ করে ৬৫ শতাংশ শিশু।
শিক্ষাবিদদের মতে- এইসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য একমাত্র উপায় হলো পথশিশুদের শিক্ষিত করে তাদের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলা। তাদের শিক্ষিত করে যদি দেশের অর্থনীতিতে কাজে লাগাতে পারি তাহলে অচিরেই সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব। এদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। আমাদের সবার সচেতনাই পারে পথশিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে।
পথশিশুরা নানা অভাবে জর্জরিত। অভাব অনটনে তাদের অনেকে জড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে। রাজধানীতে সন্ত্রাস জন্ম হওয়ার বড় একটি কারণ পথশিশুরা। তাদের অনেকে অভাব অনটনে বাধ্য হয়ে বেছে নিচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আর কিছু সুবিধাভোগী মানুষ তাদেরকে অন্ধকার জগতের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এইসব শিশুদের শিক্ষিত করার জন্য সরকারের নেই জোরালো পদক্ষেপ। তবে ছিন্নমূল শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার একটি বস্তিতে গড়ে উঠেছে ‘জুম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন স্কুল’। ছিন্নমূল শিশুদের শিক্ষাদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংগঠন বর্তমানে গুলিস্তান ও পলাশীসহ তিনটি শাখায় প্রায় আড়াই শতাধিক পথশিশুকে পাঠদান করছে।
অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পথশিশুদের শিক্ষার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে ‘স্বপ্ন পাঠশালা’। পথশিশুদের পাশে এগিয়ে আসতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই সংগঠনটি গড়ে উঠেছে। পথশিশুদের শিক্ষা নিয়ে সংগঠনটির নানা পরিকল্পনা বিষয়ে দৈনিক অধিকারের সঙ্গে কথা বললেন ‘স্বপ্ন পাঠশালা’র সদস্য হিরণময় বিশ্বাস।
স্বপ্ন পাঠশালায় কতজন পথশিশুদের পাঠদান করা হয় সে সম্পর্কে জানতে চাইলে হিরণময় বলেন, ‘প্রতি শুক্রবার স্বপ্ন পাঠশালায় প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হয়। আগে সপ্তাহে দুই দিন-শুক্রবার ও মঙ্গলবার পথশিশুদের পড়ানো হতো। এখন স্বেচ্ছাসেবীদের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘পথশিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকারি-বেসরকারি ও ন্যাশনাল ভার্সিটির শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে মূলত গড়ে ওঠেছে ‘স্বপ্ন পাঠশালা’। এই সংগঠনে আমরা প্রায় ২৫-৩০ জন সেচ্ছাসেবী কাজ করে যাচ্ছি।’
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে পথশিশুদের পড়াশোনার জন্য নেই কোনো বিশেষ ব্যবস্থা।
বারিধারা মডেল হাইস্কুলের শিক্ষক তানভীন সুলতানার কাছে কিন্ডার গার্ডেন স্কুলগুলোতে পথশিশুদের পড়াশোনার সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি দৈনিক অধিকারকে জানান, ‘আমাদের স্কুলে মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা পড়াশোনা করে। কিন্তু পথশিশুদের পড়াশোনার জন্য এখানে কোনো ব্যবস্থা নেই।।’
তিনি বলেন, ‘পথশিশুদের যতই শিক্ষার উপকরণ দেওয়া হোক না কেন, তাদের আগে পেটে ভাত দিতে হবে। খাবার নিশ্চিত করার পর তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হলেই সম্ভব তাদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলা সম্ভব।’
কিন্ডার গার্ডেন স্কুলগুলোতে পথশিশুদের পড়ার সুযোগ কিভাবে দেওয়া সম্ভব সে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সকল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারের একটি নির্দেশনা দিতে হবে যেন, পথশিশুরা সরকারি স্কুলের পাশিপাশি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফ্রিতে পড়ার সুযোগ পায়। তাছাড়া তাদের দুপুরের টিফিনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে আর তাদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হবে না।’
পথশিশুদের জন্য আলাদা একটি বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হলে তাদের একই স্থানের খোঁজে পাওয়া সম্ভব বলে জানান তিনি।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড