• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

সাত রঙের চা নিয়ে শাবি শিক্ষার্থীদের গবেষণা

  শাবি প্রতিনিধি

২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২২:২১
সাত রঙের চা

দেশের অন্যতম পর্যটন প্রসিদ্ধ স্থান চায়ের রাজধানী খ্যাত শ্রীমঙ্গল। শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে গেছেন অথচ ৭ রঙের চায়ের স্বাদ নেয়নি- এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। ৭ রঙের এ চায়ে রয়েছে বিস্ময়, মুগ্ধতা আর পুরোটা যেন একটা রহস্য। এই রহস্যের বাধ ভাঙতে শ্রীমঙ্গলগামী দেশি বিদেশি পর্যটকরা অন্তত একবার হলেও ছুটে যান এই চায়ের স্বাদ নিতে, কিন্তু আজও এই চায়ের রহস্য সকলের কাছে অজানা।

সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের একদল শিক্ষার্থী কাজ করেছেন উদ্ভাবনের গল্প, ৭ লেয়ারের ইতিবৃত্ত, পর্যটকদের মনোভাব, চা কেবিন গড়ে উঠার ফলে চারদিকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনসহ নানা বিষয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে শাবির এই তরুণ গবেষকেরা।

উদ্ভাবকের গল্প:

এই অন্যরকম উদ্ভাবকের নাম রমেশ রাম গৌড়, তিনি ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার এক দরিদ্র পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। জানাচ্ছিলেন তার এই মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গলে আসার গল্প। তিনি জানান, ২০০০ সালের মার্চ মাসে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে জীবিকার তাগিদে শ্রীমঙ্গলে আসেন। এখানে এসে রামনগর মনিপুরি পাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে এলাকার একটি চায়ের দোকানে কাজ নেন। এরপর ২০০১ সালে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনে নিজে উদ্যোগে একটি চায়ের দোকান দেন। শুরু করেন তাক লাগানো এই স্তর বিশিষ্ট চায়ের উদ্ভাবনী। প্রথমে ২ স্তর বিশিষ্ট চা দিয়ে শুরু তার এই সাত রং এর গল্প। যা সেই সময়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। এখন তিনি ১০ রং এর চা তৈরি করেছেন যা দেশে বিদেশে তার অন্য এক পরিচিতি এনে দিয়েছে। যারাই শ্রীমঙ্গলে গিয়েছেন তারা একবার হলেও তার এই দোকানের ৭ লেয়ারের চায়ের স্বাদ নিয়েছেন। কৌতুহলবশত এই চায়ের স্বাদ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের অনেক সনামধন্য ব্যক্তিবর্গ। বিদেশি রাষ্ট্রদূত, বিভিন্ন সংস্থার প্রধান, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও ক্রীড়াবিদ ও চলচ্চিত্রাঙ্গন জগতের তারকাসহ আরও অনেকে। আর আগত পর্যটকদের কাছে এই চায়ের স্বাদের থেকে ৭ লেয়ারের প্রতি বেশি কৌতুহল সবার মাঝে। অধিকাংশ সবাই আসে এই চা ভর্তি গ্লাস দেখতে।

চায়ের রহস্য:

স্বচ্ছ গ্লাস ভিন্ন ৭টি স্তরে সাজানো এই চা এখনও সবার কাছে যেন একটি রহস্যই মাত্র। চামচ দিয়ে না ঘুটে যতই নাড়াচাড়া করেন এক স্তর আরেক স্তরে মিশবে না। যিনি প্রথম এমনটি দেখেন তার কাছে এটি চা ভাবতেই কষ্ট হবে। রহস্য জনক এই সাত রংঙের চা দেশি-বিদেশি পযটকদের কাছে ভাবনীয় বিষয়। কিভাবে একটি গ্লাসে সাতটা রঙের স্তর। এক লেয়ার অপর লেয়ারের সাথে মিশে না, কিভাবে এ চা তৈরি করা হয়। এই রহস্যময় চা পযটকদের আরও আকর্ষণন বাড়িয়ে দেয়। তাইত বেড়াতে আসা পর্যটকরা স্বাদ নেন এক গ্লাস সাত রঙের চায়ের। যিনি প্রথম বিষয়টি দেখবেন তার কাছে এটি চা ভাবতে কষ্ট হবে। আর যিনি দেখেছেন আগেও, নিয়েছেন স্বাদ, তিনি ভাববেন এটা কীভাবে সম্ভব যদি জানতে পারতাম! তবে চায়ের উপাদান, তৈরির কৌশল এখনও অজানা। শাবি গবেষক দল এই সাত রং চা এর রহস্য জানতে চাইলে রমেশ চন্দ্র বলেন, আমার চায়ের আকর্ষণ হল এর রহস্য যা আমার ব্যবস্যার মুলধন, আসলে আমি এইটা বলতে রাজি নয়। তবে এই চায়ে ক্ষতিকারক কোন কেমিকেল নেই। এই চা গ্রিন টি, ব্লাক টি, লেবু, আদা, এলাচ, মসলা, গরুর খাটি দুধ ইত্যাদিও সংমিশ্রণে তৈরি হয়। তবে এই চা উদ্ভাবনে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে বলে জানান তিনি। এটি তার অনেকদিনের গবেষণার ফল।

মানুষ হিসেব রমেশ বাবু:

তিনি একাধিকবার ইংল্যান্ডসহ অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইতালি ইত্যাদি থেকে ভালো অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছেন কিন্তু সবই ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখন তিনি দুটি দোকানের মালিক। জীবনমানে এসেছে পরিবর্তন। ছেলেদের নিয়ে তিনি পর্যায়ক্রমে দোকান দুটি দেখাশুনা করেন। রামনগরের দোকানে সাত স্তরের চা প্রতিদিন গড়ে ৩০ কাপ বিক্রি হয় ও কালিঘাটের দোকানে গড়ে ৫০ কাপ চা বিক্রি হয়। এছাড়া সরকারকে নিয়মিত ভ্যাট প্রদান করে থাকেন বলে জানান তিনি।

রমেশের দোকানের চায়ের দাম:

বর্তমানে নীলকণ্ঠ চা কেবিন নামে তার যে দুইটি শাখা রয়েছে সেখানে বর্তমানে ‘নীলকন্ঠ’ কেবিনে সাত লেয়ারের চা ৭০ টাকা, ছয় লেয়ারের চা ৬০ টাকা, পাঁচ লেয়ারের চা ৫০ টাকা, চার লেয়ারের চা ৪০ টাকা, তিন লেয়ারের চা ২০ টাকা, দুই লেয়ারের চা ১০ টাকা, হাই স্পেশাল চা ২০ টাকা, স্পেশাল দুধ চা ১০ টাকা, গ্রীন চা ৫ টাকা, আদা চা ৫ টাকা, লাল চা ৫ টাকা, ও লেবু চা ৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

প্রস্তুত প্রণালী:

প্রস্তুত প্রণালী নিয়ে কথা বলার চেষ্টা একজন চা প্রস্তুতকারীর কাছে নাম গৌরাঙ্গ। একটু আলাপেই বেশ কাথা জমে উঠল গৌরাঙ্গ দাদার সঙ্গে। তার কাছে জানতে চাইলাম সাত স্তরে সাত রঙের রহস্য। বললেন ভিতরের ঘরে চলুন। গিয়ে দেখলাম ছোট একটি ঘর। সেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। দেখলাম সাতটি আলাদা গ্লাসে সাত রঙের চা সাজানো। সেখান থেকে একটু একটু করে নিয়ে সাজাচ্ছেন সাতটি স্তর। বেশ ভাল মনের মানুষ এই গৌরাঙ্গ। এভাবে এর আগে কাউকে দেখান নি বলে জানালেন তিনি। নাড়াচড়া করলে এক স্তরের চা আরেক স্তরে মিশবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, চামচ দিয়ে না ঘুটে যতই নাড়াচাড়া করুন এক স্তর আরেক স্তরে মিশবে না। পরীক্ষা করে দেখলাম বিষয়টি একেবারেই ঠিক।

সরেজমিন বর্ননা:

আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। চমৎকার খোলামেলা পরিবেশ। দোকানের ভেতরে বসার জায়গা। বাইরেও তাই। চারিদিকে উৎসব মুখর পরিবেশ আর চায়ের আপ্যায়ন। কৌতুহলীরা এক স্তর অনুযায়ী চায়ের অর্ডার চলে। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে এই কৌতুল ভরা চায়ের কাপ। কাপ ঘুরিয়ে দেখছেন। ছোট করে চুমুক দিচ্ছেন। ঘ্রাণ নিচ্ছেন। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। এখানে আছে এক অবাককরা দেয়াল। কেীতুহলভরে কাছে গিয়ে দেখলাম সেখানে দেশের প্রায় সব ধরণের পত্রিকার কাটিং। চমৎকার করে সাজানো। সাত স্তরবিশিষ্ট চায়ের প্রশংসা করে লেখা প্রতিবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে চা আর চায়ের উদ্ভাবকের ছবি। বিদেশি চা-প্রেমী ও গবেষকদের মুগ্ধতা অনুমান করা যায় আলাদা করে সাজানো ইংরেজি কাটিংগুলো দেখে। এগুলো বিভিন্ন সময় বিদেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ইন্টারনেটের চা সংক্রান্ত আলোচনায় প্রবেশ করলেও পাওয়া যায় রমেশ রাম গৌড়কে। টেলিভিশনেও নিয়মিত সাক্ষাতকার পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে যথেষ্ট উজ্জ্বল তারকাটি তিনি। তাই তাঁকে মাত্রই চেনা গেল। চুপ করে বসেছিলেন ক্যাশ কাউন্টারে। মাঝে মধ্যেই উঠে যাচ্ছিলেন পাশের রান্নাঘরে। বোঝা যাচ্ছিল, এখনও নিজ হাতে চা বানান। তদারকি করেন। পুরো কাপ শেষ করতে করতে কথা হয় রমেশ রাম গৌড়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, অনেকেই আমাকে শ্রীমঙ্গলের মানুষ জানেন। আমার গ্রামের বাড়ি আসলে ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছায়। হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ার পর বড় বিপদ নেমে এসেছিল জীবনে। অগত্যা ভাগ্যের অন্বেষণে বের হই।

২০০০ সালের মার্চে আসি চা বাগান পরিবেষ্টিত শ্রীমঙ্গল শহরে। সঙ্গে তখন স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। পকেটে সর্ব-সাকুল্যে ১ হাজার ৫শ’ টাকা। রমেশ জানান, এরপর এই কাজ ওই কাজ হয়ে চায়ের দোকান দেন তিনি। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন কাকিয়াছড়া চা বাগানের পাশের একটি জায়গায় আর ১০ জনের মত ব্যবসা শুরু করি। তবে কাজের অন্যরকম চাওয়া ছিল আর চা কত ভাল করা যায় সেদিকে ছিল দৃষ্টি। রাতে দোকান বন্ধ করার পর চা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতাম। এভাবে আজকের এই চা তৈরি সম্ভব হয়েছে।

রমেশ আরও জানান, সরকারের টি বোর্ডসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁর চা পরীক্ষা করেছে। কিন্তু কেমিক্যাল কিংবা অস্বাভাবিক কোন উপাদান খুঁজে পায়নি। এরপর থেকে তাঁরা উল্টো তাঁর কাস্টমার হয়েছেন। বরং তারায় নিয়মিত চা খেতে আসেন এখানে।

উল্লেখ্য, সাত স্তরবিশিষ্ট চা তৈরির এ কৌশল আজ অবধি বাইরে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। শিখিয়েছেন কেবল নিজের ভাই ও তিন ছেলেকে। তাও তাদেরও দিয়ে দিব্যি করিয়েছেন কাউকে শেখানো যাবে না। এই ভাই ও সন্তানেরা এখন তাঁর চায়ের দোকানেই কাজ করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিয়ের পর মেয়েরা অন্যের ঘরে চলে যাবে বলে তাদেরও কৌশলটি তিনি শেখাননি। জানা যায়, দোকানে তিনি চা তৈরি করেন দরজা বন্ধ করে! একই কারণে নিজের দোকানের বাইরে গিয়ে কোথাও চা তৈরি করেন না। সিসিটিভি, টেলিভিশন ক্যামেরার ব্যাপারে দারুন সতর্ক থাকেন। রমেশ চান, তাঁর চা শ্রীমঙ্গলে এসেই খেয়ে যাক সবাই। এ কারণেই এমন লুকোচুরি বলে জানান তিনি। মৃত্যু পর্যন্ত এ গোপনীয়তা বজায় রাখার ইচ্ছা তাঁর।

বর্ণনাকারীর পরিচয়

চায়ের রং নাকি স্বাদ- কোনটি পর্যটকদের আকর্ষণ - এসব জানতে চলতি বছরের ১০ ও ১১ আগস্ট ২দিন শ্রীমঙ্গল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের ৬৬ জন শিক্ষার্থী ও ৭ জন শিক্ষক। শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জে চা, চা শ্রমিক ও বিভিন্ন আদিবাসীদের জীবনযাত্রা, তাদের সংস্কৃতি প্রভৃতি নিয়ে গবেষণা করতে ৬৬ জন শিক্ষার্থীকে ৬ জন শিক্ষকের অধীনে ৬টি গ্রুপে ভাগ করে গবেষণার বিষয়বন্তু নির্ধারণ করে দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালযয়র নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ড. মঞ্জুর-উল হায়দারের অধীনে সাত রং এর চা নিয়ে গবেষণা করা ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মো. মোয়াজ্জেম আফরান বিষয়টি বর্ণনা দিয়েছেন।

আপনার ক্যাম্পাসের নানা ঘটনা, আয়োজন/ অসন্তোষ সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড