• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী, অতপর কিছু কথা

  বাপ্পি লিংকন রায়

০৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৯:১১

দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী, বাংলাদেশ যা কিনা এশীয়ার মধ্যে প্রথম বিয়েনাল। ৩৬ বছরে পা দিল এবারের ১৮তম আয়োজনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের ৬৮টি দেশের অংশগ্রহণে প্রায় ৪৬৫ জন শিল্পী ও প্রায় ৫৮৩টি শিল্পকর্ম নিয়ে সরকারী অর্থায়ানে এই বিশাল আয়োজন। তবে এই প্রদর্শনীর বিশালতা ও আধিপত্য বাদ দিয়ে বিশ্লেষণ করলে নানা প্রশ্ন আসে মনে। এই প্রশ্নগুলো অতীতেও ছিল, বর্তমানে যা আরও প্রখর আকার ধারণ করেছে।

এশিয়ার ভৌগোলিক গন্ডির বাইরের অংশগ্রহণ তার দ্বিতীয় আসর থেকেই। বিয়েনালের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে প্রথম আসরের আয়োজক কর্তৃপক্ষরা বলেন, “যে পরিকল্পনা এবং ধারণাবোধ থেকে প্রদর্শনীর উদ্ভব, তা হচ্ছে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্পসত্তার তাৎপর্যকে উপস্থিত করা, যা একই সঙ্গে প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব এবং সর্বজনীন।”

তবে বর্তমান বিয়েনালে দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা সহ পৃথিবীর নানা প্রান্ত হতে শিল্পকর্ম বাছাই করা হয়েছে। এটিকে কি এখনও এশিয়ান বিয়েনাল বলা চলে? প্রদর্শনীটি যেহেতু আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কাজ গ্রহণ করা মূখ্য হয়েছে। তাই এ বিয়েনালকে আর এশিয়ান বিয়েনাল না বলে আন্তর্জাতিক বিয়েনাল বলাই ভাল। প্রশ্ন হলো, ৬৮টি দেশের অংশগ্রহণের এই আয়োজনকে কী বলব? এশিয়ান বিয়েনাল? নাকি আন্তর্জাতিক বিয়েনাল? বাস্তবিক অর্থে এই বিয়েনালের উদ্দেশ্য কী? এই প্রসঙ্গ নিয়ে মইনুদ্দীন খালেদ বলেন(২০০৪ সালে), ‘এবারের বিয়েনালে আফ্রিকার দেশগুলোও অংশগ্রহণ করেছে। তাই এটাকে শুধু এশিয়ান আফ্রিকান দ্বি-বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী বলা যায়।’

পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই বিয়েনালের আয়োজন করে থাকে। তবে সব বিয়েনালই এক নয়, একই কাঠামোয় চলে না। তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের মধ্যে থাকে যথেষ্ট ভিন্নতা। যেকোনো আয়োজনেরই একটি মূল ভাবনা, আদর্শ ও উদ্দেশ্য থাকাটা বাঞ্চণীয়। সেক্ষেত্রে আমাদের এশিয়ান বিয়েনালের মূল ভাবনা, আদর্শ বা উদ্দেশ্যটাই কী? বা এর লক্ষ্য কী? আন্তর্জাতিকভাবে আমরা কী প্রকাশ করতে চাই? সমাজের কাছে এর ভূমিকা কতটুকু?

আমাদের বিয়েনাল সুষ্ঠ পরিকল্পনা ও দক্ষ জনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মুক্তি কতটা, তা প্রশ্নাতিত। বিগত বিয়েনালগুলো নিয়েও একই প্রশ্ন এসেছে বারবার। তাই কল্পনা নয়, বাস্তবনির্ভর ভাবনাই সফল বিয়েনাল এনে দেবে। আবুল মনসুর বলেন, ‘তবে আন্তর্জাতিক পরিসরে এ প্রদর্শনীর তেমন কোনো স্বীকৃতি আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। অনেক পরে শুরু হয়েও দুবাই, বেইজিং বা এ মহাদেশেরই আরও কিছু আয়োজন বিশ্বপরিসরে মর্যাদার আসন পেয়ে গেছে। আমরা সেটি অর্জন করিনি, করার তেমন প্রয়াসও লক্ষণীয় নয়।’

বিয়েনালে অংশগ্রহণের নিয়মাবলী ও শিল্পকর্মের সাইজ নিয়েও নানা প্রশ্ন চলে আসছে র্দীঘদিন ধরে। যার কোনো নির্দিষ্ট সমাধান আজ অবধি চোখে পড়েনি। শিল্পকর্মের সাইজের ক্ষেত্রে বিদেশী শিল্পী ও দেশী শিল্পীদের জন্য দুই ধরনের নিয়ম। বাংলাদেশী শিল্পীরা নির্দিষ্ট সাইজের বড় বা ছোট কাজ দিতে পারবে না। আন্তর্জাতিক বিয়েনালগুলোতে যেখানে সকল শিল্পীর জন্য একই নিয়ম বহাল থাকে। সেখানে আমরা কি দৃষ্টান্ত রাখছি? এই ধারা আমাদের কী শিক্ষা দিচ্ছে? দেশী–বিদেশী কোন বিভেদ তৈরী করছি না তো?

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর এক লক্ষ বিশ হাজার বর্গফুট তিনতলা ভবনের সুবিশাল পরিসর। যেখানে ৫৮৩টি শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর জন্য কতটুকু স্থান প্রয়োজন কিংবা নতুন কী সংযোগ করতে হবে, তা নিশ্চয় অজানা নয়। প্রদর্শনীতে বহু কাজ কাছাকাছি এমনভাবে সাজানো যা দৃষ্টিকটু ও বিরক্ত তৈরি করে। অনেক ছবির সঙ্গে তো আবার শিল্পীর নামই ছিল না। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, বেশকিছু ভিডিও প্রদর্শনীর শুরুতেই চলছিল না। কর্তব্যরত কর্মকর্তারা জানান ভিডিও হারিয়ে গেছে বা টেকনিক্যাল সমস্যা। পরে সেগুলো চালু করা হলেও কোনো বর্ণনা দেওয়া হয়নি। এমন উদাসীন আচারণে ভিডিও আর্টের শিল্পীরা খুবই মনক্ষুন্ন হয়। অন্য দিকে অনেক ছবির জন্য লাইট না থাকায় আয়োজক কমিটির সদস্য জানায় লাইটের বাজেট নেই। কথাটা কতটা ভিত্তিহীন তা বিয়েনালের বাজেটের দিকে নজর দিলে বোঝা যায়।

এতো মাত্র কয়েকটি মূল সমস্যার কথা বললাম। এতে কি আমাদের বিয়েনালের মান উচ্চ হয়েছে? কী ধরনের সংস্কৃতির পরিচয় বহন করছি আমরা?

আমাদের বিয়েনালকে আমি আন্তর্জাতিক বিয়েনালই বলব, যেখানে ৬৮টি দেশের পতাকা তোলা হয়েছে। আমদানি করা হয়েছে সে সব দেশের শিল্পকর্ম। এই ফ্রান্স, ইতালি কিংবা আরব শিল্পীরা কারা? তাদের শিল্পকর্মের মানটাই বা কী? নিজ দেশে তাদের অবস্থান কী? তাদের শিল্পকর্মের ভাষা আন্তর্জাতিকভাবে কতটা গ্রহনযোগ্য? তাই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী যতটা ঠিকঠাকভাবে আয়োজন করা সম্ভব, তাই করা উচিত। কারণ, বিয়েনালের পোস্টার দেখে বা শিল্পকলা একাডেমির বাইরে পতাকার সারি দেখে যতটা মন পুলকিত হয়, গ্যালারিতে ঢুকলে তার কয়েক গুণ বেশি চুপসে যায়। তাই, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সবাই দ্রুত যাচাই করতে পারে বিধায় তরুণদের বা বাংলার শিল্পপ্রেমীদের টুপি পরিয়ে বোঝানো যাবে না।

১৮তম বিয়েনালে নতুন যোগ করেছে দুটি কিউরেটর প্রদর্শনী। যা কিনা বাংলাদেশ বিয়েনালের ইতিহাসে প্রথম। পারফর্মিং আর্ট কিউরেট করেন শিল্পী মাহাবুব রহমান ও বিন্দু-বিসর্গ নামে প্রজেক্ট প্রদর্শনী কিউরেট করেন শিল্পী বিশ্বজিৎ গোশ্বামী।

পারফর্মিং আর্টে অংশ নেন দেশি-বিদেশী মোট ২৭ জন শিল্পী। ১ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর তারিখ পর্যন্ত তাঁরা ভবনের ২য় তলায় দর্শকের সামনে পারফর্ম করেন। এটি নির্দিষ্ট স্থানে অনুষ্ঠিত হওয়ায় শিল্পরসিকদের এর স্বাদ আচ্ছাদন ও ভাষা সন্ধানে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়নি। পাশাপাশি পারফর্র্মিং এর ফটোগ্রাফ বা আলোকচিত্র ও ভিডিও প্রদর্শীত ছিল পুরো মাস জুড়ে। পারফর্মিং আর্টের অংশটি ছিল খুবই পরিকল্পিত, সজ্জিত ও মার্জিত। এবার বিন্দু বিসর্গ নিয়ে বলা যাক।

কিউরেটর বিশ্বজিৎ গোস্বামী শিল্পী। বাংলাদেশের নবীন ১২জন শিল্পীকে নিয়ে তার এই যাত্রা। প্রায় পনেরো দিনের তত্ত্বাবধায়নে কাজগুলো প্রদর্শীত হয় তৃতীয় তলার ৪নং গ্যালারীতে। এই প্রজেক্টে অংশ নেওয়া শিল্পীরা হলো: আমিনুল ইসলাম আশিক, কুন্তল বাড়ৈ, ইমাম মাহাদি, খোকন চন্দ্র সরকার, কুতুবুল ইসলাম অভি, মোহাম্মদ অতিকুর রহমান, মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম অপু, প্রদিপ সাহা, পুসন হালদার, সাকিব সেলিম, সোমা সুরভি জান্নাত, আজিজি ফউমি খান।

প্রজেক্ট সম্পর্কে কিউরেটর বিশ্বজিৎ বলেন, ‘ভিন্ন ধারার কাজ করতে আগ্রহী কিংবা করছে এমন ১২জন নবীনকে বেছে নিয়েছি। যারা গুরুত্ব পেয়েছে কাজ দিয়ে, প্রতিষ্ঠান দিয়ে নয়। শিল্পীরা তাদের ভাবনা ও মনন থেকেই কাজগুলো করেন। কিউরেটরের অনুপ্রেরণায় যা নতুন মাত্রা যোগ করে। ছবি প্রদর্শনের জন্য দেওয়ালের রং পরিবর্তন ও পর্যাপ্ত লাইটের ব্যবস্থা করা হয়। যা কিনা অন্য সব গ্যালারীতে চোখেই পড়েনি। একজন শিল্প নিদের্শকের হাতে গ্যালারী ও শিল্পকর্ম কী নান্দনিক রূপ লাভ করে তার উদাহরণ ‘বিন্দু বিসর্গ‘।’

মোটকথা হলো, বিয়েনালের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বলোকে আমাদের নিজস্ব সুকুমার সত্তাটাকে কতটা প্রসারিত করতে পেরেছি? আর আমাদের এই আয়োজন বিশ্বের শিল্প সমাজে কতটা সার্থক ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে? কথা হলো আমরা কী ধরনের বিয়েনাল চাই? কিউরেটাল বিয়েনাল নাকি দলীয় বিয়েনাল? কাদের ছবি প্রদর্শন করব? বিভিন্ন দেশে যারা ভাল কাজ করছে তাদের? আন্তর্জাতিকভাবে যারা সম্মানিত তাদের? নাকি কনটেম্পোরারি কাজ করছে তাদের?

বিয়েনালের পূর্বে আমরা কী করব? কোন ধরনের কমিটি গঠন করব? সমন্বয়ের দায়িত্ব কাকে দিব? এই সব প্রশ্ন আগেও হয়েছে, এখনো চলছে। তাহলে এসকল প্রশ্ন কি কখনো উত্থাপিত হয়নি? প্রতি বিয়েনালের কমিটির আলোচনায় দেশের স্বনামধন্য শিল্পীরা থাকেন। তারা কি কখনো একথা ভাবেননি বা বলেননি? তারা কি এসব প্রশ্ন আয়োজক কমিটির সভায় ঊত্থাপন করেননি? নাকি আয়োজক কমিটি তাদের কথা বা প্রস্তাবকে আমলেই নেননি? তাহলে তাদের কমিটিতে রেখে প্রহসন করার অর্থটা কী? এখানে কি ব্যক্তি স্বার্থই প্রধান হয়ে উঠছে? যে কারণে বিয়েনাল শেষ হয়, নতুন বিয়েনাল আসে; কিন্তু সমাধান করার কারও স্বদিচ্ছা নেই।

তাই, শুধু ভাবনা থাকলেই হবে না, তার একটি নৈতিক ভিত্তিও থাকা চাই। বিয়েনালটির গৌরব অর্জনের লক্ষ্যে বারবার যে মান নিয়ন্ত্রণ ও মান উন্নয়ণের কথা উঠছে তা পূরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে যোগ্য ব্যক্তিদের কিউরেটিং ও সমন্বয়ের দ্বায়িত্ব দিতে হবে। কোনো অনবিজ্ঞকে ব্যক্তি পরিচয়ের ভিত্তিতে নিয়োগ না দিয়ে শিল্পের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, শিল্প সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা আছে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে। তবেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ বিয়েনালের গৌরবময় আগামী সূচনা হবে।

তথ্যসূত্র :

১. আবুল মনসুর, এশীয় প্রদর্শনী; দু চার কথা, শিল্পকথা শিল্পকথা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা ২০১৬ ২. মতলুব আলী, প্রসঙ্গ প্রগুক্ত পৃ-৬২, দ্বি বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী ৩. আবুল মনসুর, এশীয় প্রদর্শনী, এশীয় থাকবে না?, দৈনিক প্রথম আলো, ঢাকা ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড